ভালবাসার ফুলে পুঁজিবাদের ছোঁয়া

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন বানিজ্য সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাঙালির বসন্তবরণ, বিশ্ব ভালবাসা দিবস ও ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসকে ঘিরে রূপগঞ্জের মাসুমাবাদ ও ভোলাবো এলাকার ফুল চাষীরা ব্যস্ত সময় পার করেন। উপজেলার এ দু’গ্রামের ফুল যায় সারাদেশে। দিবসগুলোকে ঘিরে ভালবাসার ফুলে লেগেছে বাণিজ্যের ছোঁয়া। এবার প্রায় দেড় কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশাবাদী স্থানীয় ফুল চাষীরা। দিন দিন বেড়েই চলছে ফুলের চাষ ও এর ব্যবহার।
রূপগঞ্জের ভোলাবো ও মাসুমাবাদ এলাকাজুড়ে আবাদ করা হয়েছে নানা জাতের ফুল। গাঁদা, গোলাপ, রজনিগন্ধা আরো নানা জাতের ফুল চাষ হচ্ছে এখানে। সকালে ফুলের সৌরভে চারদিক মৌ মৌ করে। হাল্কা বাতাস এই গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে আশপাশের এলাকায়।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাবো ও মাসুমাবাদ এলাকার ফুল চাষীরা রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে। এক দশক আগেও এখানে ধান, আলু, মরিচ, মূলা, বেগুনসহ প্রচলিত মৌসুমী ফসলের চাষাবাদে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কৃষি কার্যক্রম। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। সনাতনি সে চাষীরা এখন জমির পর জমিজুড়ে আবাদ করছে নানা জাতের ফুল।
চাষীরা জানিয়েছেন, অন্যান্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষে লাভ অনেক বেশি। ফুল চাষ করে জীবনকে বদলে নিয়েছে রূপগঞ্জ উপজেলার অনেক কৃষক ও বেকার যুবক। ফুলকে পুঁজি করে তারা এখন ব্যবসাসফল।
সরেজমিনে দেখা যায়, এলাকাগুলোতে চাষ করা হয়েছে লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, রজনীগন্ধা, গাঁদা, বেলি, কামিনী, সূর্যমুখী, ডায়মন্ড, গরম ফেনিয়া ও চন্দ্র মল্লিকাসহ নানা জাতের ফুল। কথা হয় মাসুমাবাদ এলাকার সফল ফুল চাষী নাঈম মিয়ার সঙ্গে।
তিনি জানান, ১৯৮৮ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দেন। এসময় ৪ ভাই-বোনসহ ৭ জনের সংসারে অভাব অনটন দেখা দিয়েছিল। তখন ভাই বোনদের মধ্যে নাঈম সবার বড় হওয়ায় পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা না করে নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। চাকরি নেন সিদ্ধিরগঞ্জ এলকার সমতা নার্সারীতে। একটানা ৪ বছর চাকরি করেন সেখানে। এরপর রাজধানী ঢাকার এক ফুলের দোকানের তিন বছর চাকরির অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে নেমে পড়েন ফুল চাষে। কোন প্রকার প্রশিক্ষণ ছাড়াই বাড়ির পাশের ২০ শতাংশ জমিতে ফুলের চাষ করেন তিনি। প্রথম বছরেই পাঁচ হাজার টাকা পুঁজিতে লাভ হয় প্রায় দশ হাজার টাকার মতো।
নাঈম মিয়া আরো জানান, প্রথম বছরেই ভালো লাভ হওয়াতে পরের বছর আরো অধিক জমিতে ফুলের চাষ করেন তিনি। কিন্তু তখন ঢাকা শহরে নিয়ে গিয়ে ফুল বিক্রি করতে হতো। অনেক সময় উপযুক্ত মূল্য হতে বঞ্চিত হতেন মিলন। তাই তার উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য রাজধানীর শনির আখড়ায় নিজেই মল্লিক পুষ্প বিতান নামে একটি দোকান গড়ে তোলেন তিনি। বর্তমানে তিনি ৭ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের আবাদ করেছেন। এর মধ্যে গাঁদা ফুলই বেশি চাষ হচ্ছে তার জমিতে।
শুধু নাঈম মিয়াই নন, তার মতো এই এলাকার জয়নাল, বাতেন, মিয়াজ উদিদন, রফিক, দিলদারসহ আরও অনেক যুবক ফুল চাষকে পেশা হিসাবে নিয়ে জীবন পাল্টে নিয়েছেন।
ভোলাব এলাকার ফুল চাষী মিয়ািজ উদ্দিন জানান, ফুল চাষ করে তিনি সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। চার লাখ টাকা খরচ করে দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। পাকা বাড়ি নির্মাণ ও প্রাইভেটকার সব ফুল চাষের মাধ্যমে হয়েছে। তার পরিকল্পনা আরো অধিক জমিতে ফুল চাষ করা। তার মতো আরো অনেকে ফুল চাষ করে ভাগ্যকে বদলে নিয়েছে। এলাকার বেকার যুবকরা এখন ফুল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা বাড়ির আঙিনায় ফুল চাষ করে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে। আরো অনেকেই আবাদ করেছে ফুল।
চাষীরা জানান, আগে রূপগঞ্জ উপজেলার অধিকাংশ জমিতে শুষ্ক মৌসুমে রবি শশ্যসহ নানা আবাদ হতো। ফুল চাষে অধিক লাভজনক হওয়ায় চাষীরা এখন রবিশষ্য চাষের পরিবর্তে ফুল চাষের দিকে ঝুকছে।
ভোলাবো এলাকার ফুল চাষী করিম বেপারী বলেন, দিবস আসলে ব্যবসা ভাল হয়। রূপগঞ্জের ফুলের চাহিদা দেশজুড়ে। প্রতিবছরই প্রায় কোটি টাকার ফুল যায় সারাদেশে। এবার দেড় কোটি টাকার ফুল বিক্রি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
রূপগঞ্জের ভোলাবো এলাকার ফুল চাষীরা জানান, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভালবাসা দিবস, পহেলা বৈশাখ, থার্টিফার্ষ্ট নাইট, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ জাতীয় দিবসগুলো ছাড়া ও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, গায়ে হলুদ, গাড়ি সাজানো, বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বন ও সভা-সমাবেশে ফুলের বেশ চাহিদা রয়েছে। এসব দিবসে আসলে ফুলের দাম একটু বেশি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন রূপগঞ্জের আমির হোসেন, জায়েদ আলী, আব্বাসসহ কয়েকজন চাষী। তারা জানিয়েছেন, সার বীজ ও শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচ একটু বেশি পড়ছে।
একাধিক কৃষক জানান, ফুল চাষীদের সরকারিভাবে পর্যাপ্ত সুুযোগ-সুবিধা প্রদান করলে আরো অধিক হারে ফুল চাষ সম্ভব হবে।
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু ফাতেহ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান, ফুল চাষীদের পর্যাপ্ত আধুনিক প্রশিক্ষণ, ফুলের সংরক্ষণ, পরিবহন, প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, তাদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানসহ যথাযথ সহযোগিতা করা গেলে স্থানীয় ফুল চাষীরা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। তিনি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *