ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা সেই নরককুন্ড ভোলার চেষ্টা

এইমাত্র জাতীয় রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক : এক বছর আগের নরককুন্ড পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড় এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। জনাকীর্ণ ওই মোড়ে প্রতিদিন রিকশা-গাড়ির চলাচল, ব্যবসা-বাণিজ্য, লোকজনের হাঁকডাক সবই চলছে আগের মত। তবে স্বাভাবিক হতে পারেননি সেদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া লিটন, নূর আলম, সেলিম, সালাউদ্দিন, সোহেলের মত অনেকে।
গত বছর ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের সেই আগুন কেড়ে নিয়েছে ৭১ জনের প্রাণ, আহত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু কতজন যে দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, তার সঠিক সংখ্যা জানা নেই কারও। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনও ধুঁকছেন শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে, কেউ গ্রামে গিয়ে আর ফেরেননি, ফেরার ইচ্ছাও নেই তাদের।
ওই রাতে চুড়িহাট্টা মোড়ে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবন থেকে আগুন লাগার পর খুব দ্রুতই আশপাশের কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।
গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবনগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক ও পারফিউমের দোকান-গুদাম থাকায় মুহূর্তেই গোটা এলাকা পরিণত হয় অগ্নিকু-ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে ছাই হয়ে যান। আগুনের প্রচ-তায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় দোকান-পাট, রিকশা-গাড়ি।
ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে, ততক্ষণে শ্মশানে পরিণত হয়েছে চুড়িহাট্টা। ঘটনাস্থল থেকে ৬৭ জনের পোড়া লাশ মর্গে পাঠান উদ্ধারকর্মীরা। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।
সেদিন দৌড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছলেন মো. লিটন। যে ভবন থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের পশ্চিমদিকের সড়কে ‘লামিয়া স্টোর’ নামের ছোট মুদি দোকানটি তার।
ভীতিকর সেই ঘটনার বছরপূর্তির তিনদিন আগে সোমবার রাতে কথা হয় লিটনের সঙ্গে।
লিটন বলেন, সেই রাতে মুদি দোকানের সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়েছে। এখন ধার করে আবারও দোকানটি দাঁড় করিয়েছি।
অতীত ভোলার চেষ্টা করছি, স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু একদিনের জন্যও ভুলতে পারছি না সেই রাতের কথা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন, এখন রাত ১০টা ৩১ মিনিট। এই সময় সেই রাতে ঘটনাটি ঘটেছিল। দেখেন, আমার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেছে, ভয়ে কাঁপছি।
সেই রাতে চুড়িহাট্টা মোড় দিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে যাওয়ার সময় আহত হয়েছিলেন পটুয়াখালীর গলাচিপার মান্নান আকনের ছেলে নূর আলম। ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গ্রামে গিয়ে আর ফেরেননি তিনি। তিনি বলেন, ভালো আছি। সেই রাতে মাথা, হাত কেটে গিয়েছিল। মাথায় ২৫টি সেলাই করেছিল। আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। এখন খুব ভালো আছি। গ্রামের বাড়িতে এসে রিকশার গ্যারেজ চালিয়ে দুই সন্তান, স্ত্রী ও স্বজনদের নিয়ে ভালোই দিন কাটছে। ঢাকায় ফেরননি কেন জানতে চাইলে নূর আলম বলেন, মন টানছে না ঢাকায় যেতে।
তবে ভয়াবহ আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া শরিয়তপুরের নাড়িয়ার কর্ণখোলার বাসিন্দা মো. সেলিম (৩০) ভালো নেই বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। তার শ্যালিকা লাকী বেগম বলেন, একটি আয়নার কারখানার শ্রমিক ছিলেন সেলিম। আগুনে তার ডান হাত, পা, কান, পিঠ পুড়ে গিয়েছিল। তিন মাস চিকিৎসা শেষে গ্রামের বাড়ি গেলেও এখনও তার পিঠের ঘা পুরোপুরি ভালো হয়নি। কোনো কাজকর্ম করতে না পারায় ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চলছে কষ্টে, বলেন লাকী। চিকিৎসার সময় সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিলেও পরে আর কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
সেলিমের মতো আহত হয়েছিলেন ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন (৪৫)। হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল কয়েকদিন। এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি তিনি।
তার বড় ভাই মো. নাসিরউদ্দিন বলেন, এখনও মাথায় ব্যথা অনুভব করে সালাউদ্দিন, পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তবে দোকানে মাঝে মাঝে যায়।
আগুনে দগ্ধ পটুয়াখালীর মির্জাপুরের সন্তোষপুরের বাসিন্দা হেলাল শিকদার অবশ্য এখন ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন তার ভাই বেলাল শিকদার।
অগ্নিকা-ের রাতে প্লাস্টিক দানা ঠেলাভ্যানে ভরে ওয়াহেদ ম্যানশনের পশ্চিম পাশের সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন মোহাম্মদ আলী ও সোহেল। হঠাৎ বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হলে দুইজন ভ্যান রেখে দক্ষিণ দিকে দৌড় দেন।
সোমবার রাতে ওই ভবনের পরিত্যক্ত নিচতলায় কয়েকজন শ্রমিককে টাকা ভাগা-বাটোয়ারা করতে দেখা যায়। সেখানেই কথা হয় সোহেলের সঙ্গে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জের বাসিন্দা সোহেল বলেন, সেই রাতে ভ্যান রেখে দৌড় না দিলে আজ বেঁচে থাকতাম না।
মোহাম্মদ আলীর কথা জানতে চাইলে বলেন, সেই ঘটনার পর মোহাম্মদ আলী গ্রামের বাড়ি উজিরপুরে চলে গেছেন, আর ফেরেননি। তার আর ঢাকায় ফেরার ইচ্ছাও নেই বলে জানান সোহেল।
ভয় এতটাই শক্ত হয়ে সোহেলের মনে গেঁথে গেছে যে, এখন ছোটখাটো আগুন দেখলেও ছুটে পালান তিনি।
চুড়িহাট্টার আগুনে নিহত ৭১ জনের মধ্যে ২৭ জন শ্রমিক। শ্রম মন্ত্রণালয় আহত দশজনকে ৫০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা খরচ দিয়েছে। আর নিহত ২৭ জন শ্রমিকের স্বজনদের প্রধানমন্ত্রী এককালীন অর্থ সহায়তা দেবেন।
এত বিলম্ব কেন জানতে চাইলে শ্রম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, নিহত শ্রমিকদের ওয়ারিশ নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন সমস্যা কেটে গেছে। শিগগিরিই নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের হাতে নগদ অর্থ দেওয়া হবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *