রোগীর তথ্য গোপন করায় আক্রান্ত হচ্ছেন চিকিৎসক

জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ১৪ এপ্রিল ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ এক রোগীকে ভর্তি করাতে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। কিন্তু, তার অন্য লক্ষণগুলো দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানতে চান রোগী কোভিড-১৯ আক্রান্ত কিনা। দ্রুত হৃদরোগের চিকিৎসা আগে পেতে চেয়েছিলেন ওই রোগীর স্বজনরা। তাই তারা রোগী যে করোনা পজিটিভ সে তথ্য গোপন করেন। সকাল ৭টায় ভর্তি করানো রোগী করোনা পজিটিভ এই তথ্য চিকিৎসকরা জানতে পারেন রাত ৮টার পর। এরপর প্রথমে লকডাউন করা হয় হাসপাতালের একটি সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট), পরে লকডাউন করা হয় হাসপাতালের অর্গান ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিট। সে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি কিন্তু, তার সংস্পর্শে আসায় ইতোমধ্যেই ১৩ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, কোয়ারেন্টিনে আছেন হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৮৮ জন, এখনও বন্ধ রাখা হয়েছে ওই সিসিইউটি।
এমন উদাহরণ দিন দিন বাড়ছেই। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগীর তথ্য গোপনের কারণে এখন পর্যন্ত এ হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ জন চিকিৎসকসহ ৪১ স্বাস্থ্যকর্মী বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ উন নবী।
পুরান ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন ২২ জন চিকিৎসক। নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ওয়ার্ডবয়সহ আরও ৩০ জনের মতো সেখানে আক্রান্ত বলে জানিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটি ( এফডিএসআর)।
আজগর আলী হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ হাসপাতাল বড় নয়, কিন্তু এখানে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ভীষণভাবে ‘অ্যাবনরমাল’। হাসপাতাল সোর্স না হলে এটা হওয়ার কথা নয়, আশঙ্কা করেন তিনি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৮ জন চিকিৎসকসহ আক্রান্ত হয়েছেন আরও ছয় স্বাস্থ্যকর্মী। রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ছয়জন চিকিৎসকসহ আক্রান্ত হয়েছেন ২৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, জেনারেল হাসপাতালগুলোতে রোগীদের তথ্য গোপন এবং কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসকসহ অন্যরা যেভাবে প্রটেকশনসহ সতর্কতা নিয়ে কাজ করেন সেভাবে নন কোভিড হাসপাতালগুলোতে এটা সবসময় করা হয়নি।
রোগীর তথ্য গোপন করায় হাসপাতালে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু নিশ্চিত কোভিড রোগী জেনে তার চিকিৎসাসেবা ও শুশ্রুষা দেওয়ার সময়ে আক্রান্ত চিকিৎসকদের সংখ্যাও তো কম নয়। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পারসোনাল প্রোটেকশন ইউনিট বা পিপিই) এবং সরকারিভাবে দেওয়া মাস্ক পরেও তো চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে শুধু রোগীর তথ্য গোপনই চিকিৎসকদের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার একমাত্র কারণ নয়।
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটি (এফডিএসআর) জানিয়েছে, ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭১ জন চিকিৎসক। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩০৫ জন, বরিশালে নয়জন, খুলনাতে ১০ জন, চট্রগ্রামে ১৫ জন, ময়মনসিংহে ২৪ জন, রংপুরে তিন জন এবং সিলেট বিভাগে ৫ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে একজনের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর তথ্য গোপন, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, সঠিক ও মানসম্পন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব, নন কোভিড হাসপাতালগুলোতে কোভিড পজিটিভ রোগীর ভর্তি অথবা বহির্বিভাগে চিকিৎসার কারণেই মূলত এত বেশি চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ। এর কোনোটির বিষয়েই শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদফতর সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি অথবা ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে।
চিকিৎসকরা কেন এত আক্রান্ত হচ্ছেন জানতে চাইলে এফডিএসআর এর যুগ্ম সম্পাদক ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী বলেন, পিপিই পরার ক্ষেত্রে এবং কাজ শেষে সেটা কীভাবে খুলে রাখতে হবে এ নিয়ে বোঝাবুঝিতে একটু ঘাটতি রয়েছে আমাদের, আবার বিভিন্ন হেলথ কমপ্লেক্সে পিপিই খুলে রাখার পর নিজেদের পরিচ্ছন্ন করার মতো অবকাঠামো নেই–যেগুলো পিপিই পরার ক্ষেত্রে একটি ‘প্রি-রিকুইজিট’। আর পিপিইর মান নিয়ে এখন আর কিছু বলার নেই’, হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।
একইসঙ্গে কোভিড -১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর চেয়ে জেনারেল হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি এবং যেসব জায়গাতে রোগী বেশি সেখানে আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি বলেও জানান তিনি। এর কারণ হিসেবে ডা. রাহাত বলেন, বহির্বিভাগে পজিটিভ বা ক্যারিয়ার রোগীকে দেখার ফলে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি।
অপরদিকে, বাংলাদেশে ডক্টরস ফোরাম ( বিডিএফ) জানিয়েছে ২৬ এপ্রিল সকাল আটটা পর্যন্ত তাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫২ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৭৪ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১২ জন, খুলনা বিভাগে সাত জন, বরিশাল বিভাগে নয়জন, সিলেট বিভাগে ছয় জন, রংপুর বিভাগে তিন জন এবং বিভিন্ন জেলাতে রয়েছেন ১৩ জন।
রোগীর তথ্য লুকোচুরির কারণটি বাদ দিলে ‘ত্রুটিযুক্ত সুরক্ষা সামগ্রী সুরক্ষা সামগ্রী সঠিকভাবে পরা ও ব্যবহার করতে না পারা এত বিপুল সংখ্যক চিকিৎসকের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্তের প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিডিএফ এর প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাশ।
তিনি বলেন, একইসঙ্গে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, রোগীর তথ্য লুকানো–সব চিকিৎসকদের একসঙ্গে এক্সপোজ করা, চিকিৎসকদের প্রয়োজন অনুযায়ী কোয়ারেন্টিনে না পাঠানোও চিকিৎসকদের আক্রান্তের পেছনে দায়ী।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্যানুযায়ী, ২৭৬ জন চিকিৎসক, ১০৭ জন নার্স এবং ২৪০ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীসহ মোট ৬২৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন।
শুরুতে আমরা ‘ঝামেলা’ করে ফেলেছি মন্তব্য করে বিএমএ-র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ছিল না চিকিৎসকসহ অন্যদের, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি ঠিকমতো। একইসঙ্গে ভালোমানের পিপিই দিতে পারি নাই, রোগীরা তথ্য লুকাচ্ছে আর সবশেষ হচ্ছে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত অবনতি।
ডা. ইহতেশামুল হক বলেন, হাসপাতালের কী করে এসব রোগীকে হ্যান্ডেল করা হবে সে সম্পর্কে কোনও নির্দেশনা ছিল না, সব রোগীকে সব চিকিৎসক হ্যান্ডেল করেছেন-এদের মধ্যে কে পজিটিভ কে নয় সেটা রোগী নিজেও জানেন না বা জেনেও গোপন করছেন তার থেকেই চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন।
কীভাবে চিকিৎসকরা এত আক্রান্ত হচ্ছেন জানতে চাইলে ইব্রাহীম কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও কার্ডিওলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. এম এ রশীদ বলেন, আননোন (অশনাক্ত) বা তথ্য লুকিয়ে রোগী আসার কারণে এটা হয়েছে প্রথমত। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসকসহ অন্যদের পিপিই’র মান সঠিক ছিল না। আমরা পিপিই ব্যবহার করেছি, কিন্তু সেগুলো রেকমেন্ডেড পিপিই ছিল না, বিভিন্ন সোর্স থেকে সংগ্রহ করেছিলাম আমরা, কিন্তু কারেক্ট-ডেজিগনেটেড ছিল না, মাস্ক ছিল না- এটাই মুখ্য কারণ। নয়তো এত ম্যাসিভ ফর্মে চিকিৎসকসহ অন্যদের আক্রান্ত হবার কারন নেই। আমরা তো পিপিই পরেই চিকিৎসা দিয়েছি, তারপরও আমরা আক্রান্ত হচ্ছি।
একই প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, হেলথ ম্যানপাওয়ার (স্বাস্থ্য জনশক্তি) ব্যবহার করার জন্য সরকারের কোনও গাইডলাইন নাই। সামনে সারিতে কতজন, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সারিতে কতজন করে চিকিৎসক থাকবেন সে গাইডলাইন শুরুতেই দরকার ছিল, অথচ সেটা এখনও হয়নি।
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে সুরক্ষা সামগ্রীগুলোকে মানসম্পন্ন হিসেবে মানতে নারাজ এই বিশেষজ্ঞ। আর সবশেষ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, রোগীরা সবসময় সত্যি বলছে না হিস্ট্রি দেওয়ার সময়ে। এতে অনেক সময় ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে এবং হয়-আর এসব কারণেই চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন এত বেশি পরিমাণে, বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।


বিজ্ঞাপন