সংক্রমণের আরেক ফাঁদ!

অর্থনীতি জাতীয় স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : কয়েক দফায় বাড়ানোর পর সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটির মেয়াদ ৫ মে পর্যন্ত। এ ছুটির মধ্যে রোববার প্রথম দফায় রফতানিমুখী ৬ শতাধিক তৈরি পোশাক কারখানা চালু করেছেন মালিকরা। গতকাল সোমবার নতুন করে আরও ৫ শতাধিক কারখানা চালু করা হয়। পর্যায়ক্রমে সব গার্মেন্টস খোলা হবে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে কয়েক দফা বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। বিভিন্ন কৌশল ও তদবিরের মাধ্যমে ‘অর্থনীতির চাকা সচল’ রাখার দোহাই দিয়ে কারখানাগুলো চালু করেছেন মালিকরা।
এ বিষয়ে মালিকপক্ষ বলছে, তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই কারখানা খুলছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। গ্রামে থাকা কারখানা শ্রমিকদের ফিরিয়ে না আনতে কারখানা মালিকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেসব শ্রমিক আসছে তাদের উৎসাহী শ্রমিক বলছেন তারা।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি এম এ রহিম বলেন, আমরা স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। এজন্যই গ্রামে থাকা শ্রমিকদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। যানবাহন চলাচল শুরু হলে বা আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এরপরও কেন তারা (শ্রমিক) আসবে? আমার মনে হয়, কাজ করলে বেতন পাবে সেজন্য আসছে। কোনো কারখানামালিক তাদের আসতে বলে থাকলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
কিন্তু এই সময়ে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চাকরি বাঁচাতে অসংখ্য শ্রমিক পায়ে হেঁটে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হলে ৫ এপ্রিল রাতে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত আবারও কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় মালিকপক্ষ। এরপর তারা সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে কারখানা বন্ধ করে আসছে। সরকারের সাধারণ ছুটি আগামী ৫ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলেও কারখানামালিকরা ছুটির মেয়াদ আর বাড়ায়নি। তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা গ্রাম থেকে ফিরতে শুরু করেছেন।
যেসব শ্রমিক ইতিমধ্যে রাজধানীসহ আশপাশের গার্মেন্ট অধ্যুষিত এলাকায় ফিরেছেন তাদের অনেকেই পড়েছেন আরেক ভোগান্তিতে। সংক্রমণের ভয়ে অনেক বাড়িওয়ালা তাদের প্রবেশ করতে দেয়নি। সহকর্মীদের বাসায় থাকতে হচ্ছে তাদের। তবে তাদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে এই শঙ্কায় এলাকাবাসীও বাড়িওয়ালাদের চাপ দিচ্ছেন।
গাজীপুর মহানগরীর ভোগড়া এলাকার বাড়িওয়ালা রুকনোজ্জামান জানান, গাজীপুরে কড়াকড়িভাবে লকডাউন চলছে। সিটি করপোরেশন ও পুলিশের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে ঘর থেকে বের না হওয়ার জন্য। কিন্তু ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলবে এমন খবরে ছুটিতে গ্রামে যাওয়া ভাড়াটিয়ারা আসতে শুরু করেছেন। মানা করলে ভাড়াটিয়ারা বলছেন, ২৬ তারিখ কারখানায় কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকেব না। এলাকাবাসীও এদের বাসায় না ওঠাতে নিষেধ করেছেন।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা থেকে সাহরি খেয়ে গতকাল সকালে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার উদ্দেশে রওনা হন আশরাফ উদ্দিন। ভেঙে ভেঙে রিকশা ও ভ্যানে চড়ে বিকেল ৩টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তায় আসেন তিনি।
আশরাফ বলেন, শুক্রবার কারখানার সুপারভাইজারকে ফোন দিলে তিনি কারখানায় আসতে বলেন। সাধারণত ১০০-১৫০ টাকা ভাড়া লাগে। কিন্তু এবার খরচ হয়েছে সাড়ে ৪০০ টাকা। রায়হানুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক জানান, জামালপুর থেকে জয়দেবপুর আসতে ৬০০ টাকা খরচ হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় লাগত দুই থেকে আড়াইশ টাকা। সামিউল আলম নামের আরেক শ্রমিক জানিয়েছেন, তিনি পায়ে হেঁটে ও রিকশায় ঢাকা এসেছেন।
এ ছাড়া লকডাউনে থাকা নারায়ণগঞ্জ এলাকার নিটিং, ডায়িং ও স্যাম্পলিং বিভাগ ২৬ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে খুলবে। এসব এলাকার কারখানার কাটিং বিভাগ ২ মে, সুইং বিভাগ ৩ মে এবং ফিনিশিং বিভাগ ৪ মে খুলবে। প্রথম পর্যায়ে খোলার সময় কারখানা ৩০ শতাংশ শ্রমিক উপস্থিত থাকবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে উপস্থিত থাকবে ৫০ শতাংশ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শ্রমিক সংখ্যা বাড়ানো হবে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা তদারকিতে কয়েকটি কমিটি করা হয়েছে। মোট ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক গ্রামে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, কারখানা খোলার বিষয়ে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই সরকার ও মালিকপক্ষ আলোচনা করে আসছে। ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তিনিও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে মত দিয়েছেন। তবে সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের সঙ্গে গত ২৩ এপ্রিল ব্যবসায়ীরা বৈঠক করেন। বৈঠকে শর্তসাপেক্ষে কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। প্রাধান্য পাওয়া শর্তগুলো হলো ক্রমান্বয়ে এলাকাভিত্তিক কারখানা খুলতে হবে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
গ্রামে অবস্থানরত শ্রমিকদের এই মুহূর্তে কারখানায় আনা হবে না। অনুপস্থিত কোনো শ্রমিককে বরখাস্ত বা চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না। কারখানাগুলো স্বাস্থ্য নির্দেশনা মানছে কি না তা নিয়মিত তদারকি করতে হবে। গ্রামে থাকা শ্রমিকরা যাতে কাজে ফিরতে না পারেন সে বিষয়ে প্রশাসনকেও অবহিত করা হয় বৈঠকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর এক শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘আমরা যা করছি তা সরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষেই করছি। প্রতিটি পদক্ষেপের বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত অবগত আছে। আর সব কারখানামালিককে বলে দেওয়া হয়েছে যাতে তাদের গ্রামে থাকা শ্রমিকদের এই মুহূর্তে ফিরিয়ে না আনে। প্রশাসনকেও এ বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে তারা গ্রাম থেকে ফিরছে?’
শ্রমিকদের বেতন নিয়ে নতুন নির্দেশনা : সাধারণ ছুটি চলার সময়ে বেশিরভাগ কারখানা লে-অফ ঘোষণা করেছে। এতে এক বছরের কম সময়ে কর্মরত শ্রমিকরা কোনো বেতন পাবেন না। বাকিরা মূল বেতনের অর্ধেক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন। ফলে তাদের বেতন অনেক কমে যাবে। এ ছাড়া লে-অফের কারণে এই রোজার ঈদের বোনাস নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সরকারের নির্দেশনায় এপ্রিলে লে-অফ ঘোষণা করা কারখানায় বেসিকের ৫০ শতাংশের পরিবর্তে ৬০-৭০ শতাংশসহ বেতন পরিশোধের কথা বলা হতে পারে। এমনকি শতভাগ বেতন পরিশোধের নির্দেশনাও আসতে পারে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। গ্রামে থাকা শ্রমিকদের বিষয়েও ওই নির্দেশনায় করণীয় উল্লেখ করা হবে। এ বিষয়ে বিকেএমইএর পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমরা নিজ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করব।
ইতিমধ্যে কারখানামালিকরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। গ্রামে থাকা শ্রমিকদের এই মুহূর্তে ঢাকায় আনার প্রশ্নই আসে না। তবে তারা এপ্রিলের বেতন কনফার্ম পাবে। মে মাসের বেতন পাবে কি না তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কারণ, দ্বিতীয় দফায় তারা সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করে গ্রামে কেন গেল? এখন সরকার তাদের বিষয়ে যা বলবে আমরা তা মেনে নেব। আমরা আবারও বলছি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আমাদের সবার আগে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, পোশাকশিল্পের ৮৬৫টি কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি আছে। এ পর্যন্ত তিন বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। আমাদের ওপর কারখানা খুলে দেওয়ার চাপ আছে। অনেকের অর্ডার আছে। এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দিনক্ষণ বেধে, সীমিত আকারে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে কারখানা খুলে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে তিনি সবার সহযোগিতা চান।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে যদি অর্ডার চলে যায়, তাহলে তা ফেরত আনা কঠিন হবে। তাই সীমিত শ্রমিক নিয়ে সীমিত আকারে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। এ কারণে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমইএ ২৬ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটিতে কারখানা বন্ধ রাখার কোনো নির্দেশনা দেয়নি।
বিজিএমইএ’র বার্তায় আরও বলা হয়েছে, মানবিক কারণে শ্রমিকদের ছাঁটাই না করার জন্য সদস্যদের অনুরোধ করা যাচ্ছে। অনুপস্থিত শ্রমিককে এপ্রিল মাসের বেতন পৌঁছে দেওয়া হবে।
এদিকে পোশাক কারখানা খোলায় সতর্কতা অবলম্বন বিষয়ে গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিবের কাছে আবার চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ)। গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়ে সংগঠনটির পক্ষে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাক কারখানায় চল্লিশ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যারা এখনও দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন, স্বল্প শিক্ষিত এবং করোনার সংক্রমণের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তত সচেতন নন। এদিকে পবিত্র মাহে রমজান মাস চলছে, সামনে পবিত্র ঈদ। এ সময়ে শ্রমজীবী মানুষের বিশাল একটি অংশের জন্য নিরাপদ কর্ম এলাকা, কর্মস্থলে অসংক্রমিত যাতায়াত, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিত করা দরকার। এসব নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে একাধিক শিফট চালু করা যেতে পারে।
ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, এ শ্রম শিল্পে শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মীকে সুস্থ রাখার স্বার্থে পরীক্ষামূলকভাবে প্রশাসনের নজরদারিতে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় প্রথমে কারখানা খোলা রাখা যেতে পারে। শ্রমজীবী মানুষের সুস্থতা ও নিরাপত্তা শুধু কারখানা মালিকের ওপর ছেড়ে দেওয়া সঙ্গত হবে না। সেজন্য প্রশাসন, স্বাস্থ্য অধিদফতর, পরিবহন, শ্রম পরিদর্শক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন। অন্যথায় বিগত সময়ের বিভিন্ন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে এবং বিদেশে পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমতাবস্থায় তৈরি পোশাক কারখানায় সংক্রমণ নিরোধ ব্যবস্থা, শ্রমিকের নিরাপত্তা, করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সচেতনতা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাই। এ সতর্কতা শিল্প কারখানার জন্য একান্ত আবশ্যক বলে মনে করেন সংগঠনটির সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন।


বিজ্ঞাপন