গোপন রোগীই বেশি ভয়াবহ

এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে দেশে আগামী দিনগুলো সবচেয়ে সঙ্কটময় হতে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তারা বলছেন, দেশের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়টি অপেক্ষা করছে। আগামী কয়েকদিন বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ হবে। যতই আমরা সীমিত পরীক্ষা করি এবং পরীক্ষায় বিলম্ব করি না কেন, সামাজিক সংক্রমণ বিস্তৃত হয়েছে এবং এই পরিস্থিতি যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে পরিস্থিতি আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে সবচেয়ে আতঙ্কের যে দুটি বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা, তার একটি হলো আমাদের প্রচুর সংখ্যক গোপন রোগী রয়েছে এবং আমাদের দেশে নীরব সংক্রমণ হচ্ছে। এই দুটি যদি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে তাহলে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ৬০ দিন তো নয়ই, দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে এবং দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিতে পারে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা দীর্ঘমেয়াদি মহামারির মধ্যে পড়তে পারি। বিশেষজ্ঞরা ৩ ধরণের রোগীকে গোপন রোগী বলছেন-
প্রথমত, যাদের কোন উপসর্গ নেই কিন্তু তারা করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এখন প্রচুর উপসর্গবিহীন রোগী দেখা যাচ্ছে, যারা অন্য আট দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক। তাদের জ্বড়, সর্দি ছাড়াও উল্লেখ করার মতো কোন উপসর্গ নেই। বাংলাদেশে এই ধরণের গোপন উপসর্গের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একজন বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, সময়ের আলো পত্রিকার সাংবাদিক হুমায়ূন কবির খোকন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তার স্ত্রী এবং পুত্র দুজনকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল। পরে যখন তাদের পরীক্ষা করা হয় তখন দেখা যায় দুজনেরই করোনা পজিটিভ। অথচ হুমায়ূন কবির খোকনের মৃত্যুর পরও তাদের মধ্যে নূন্যতম কোন উপসর্গ ছিল না। আর এটিই বিশেজ্ঞরা উদ্বেগের কারণ মনে করছেন যে, উপসর্গবিহীন মানুষ যখন সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সামাজিকভাবে মেলামেশা করছেন, তখন তা সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
গোপন রোগীর দ্বিতীয় ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, অনেকেই সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে এবং নানা রকম আতঙ্কের কারণে করোনার উপসর্গ গোপন করছেন। কারণ করোনা রোগী একটি বাড়িতে শনাক্ত হলে ওই বাড়িটি ‘লক ডাউন’ করা হচ্ছে। তাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। আবার অনেক এলাকায় তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা যাচ্ছে, একঘরে করে রাখা হচ্ছে। এরকম বাস্তবতায় মানুষ সামান্য উপসর্গ নিয়ে তথ্য গোপন করছেন।
যেমন অনেকের জ্বড়, সর্দি, কাশি হচ্ছে কিন্তু তারা বাসায় ওষুধ খেয়ে এই তথ্যটি গোপন করছেন, পরীক্ষা করাচ্ছেন না। কারণ পরীক্ষা করালে যদি করোনা পজিটিভ হয় তাহলে তারা একটি প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। এ কারণেই তারা তথ্য গোপন করে থাকছেন। এদের অনেকেরই হয়তো করোনা পজিটিভ আছে। তারাও এক ধরণের গোপন রোগী। তাদের মাধ্যমে সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।
তৃতীয়ত, গোপন রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যারা পরীক্ষা করতে পারছেন না। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষার জন্য টেলিফোন করা এবং পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভিড় করা মানুষের সংখ্যা কম নয়। এই মানুষগুলোর মধ্যে যে হারে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ হচ্ছে, আমরা সেই ১১ শতাংশের কথাও যদি ধরি তারা যখন অবাধে চলাফেরা করছেন তখন এই গোপন রোগীরাও সমাজে এক ধরণের বড় ঝুঁকি তৈরী করছে।
গোপন রোগী বলতে চতুর্থ ধাপে যেটা বলা হচ্ছে, যে সমস্ত রোগীরা বুঝতে পারছেন করোনা উপসর্গ তার মধ্যে আছে, তার সরকারী উদ্যোগে চিকিৎসা সম্ভব নয়, তখন তিনি তথ্য গোপন করে কোন প্রাইভেট হসপিটালে যাচ্ছেন। যাওয়ার ফলে সেখানে তিনি সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তার একটি বড় কারণ হলো এ ধরণের রোগীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গোপন রোগীরা হলো বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। এই গোপন রোগীদের কারণেই নীরব সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার হার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম হলেও সেই রোগীর হার অনেক বেশি।
এরফলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই কম পরীক্ষা নিয়েই যখন সারাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। তখন সামাজিক সংক্রমণের বড় ঝুঁকি আমাদের সামনে রয়েছে। তারা বলছেন যে, যদি এ ধরণের সামাজিক সংক্রমণ বাড়তে থাকে এবং গোপন রোগীদের চিহ্নিত করতে না পারি তাহলে আমরা তছনছ হয়ে যেতে পারি।
আর এ কারণেই দ্রুত পরীক্ষা করে সমস্ত রোগীদের চিহ্নিত করে তাদের আলাদা করা এবং যে সমস্ত এলাকাগুলোতে সংক্রমণ হয়েছে, সেই সমস্ত এলাকাগুলোতে লক ডাউন বা পৃথক করার কোন বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি উপসর্গসহ একজন মানুষকে যথাযথ সময়ে পরীক্ষা না করে আইসোলেশনে না নেয়া বা চিকিৎসা না দেয়া হয়, তাহলে তার মাধ্যমেই সামাজিক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। এখানেই এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের অপেক্ষা করছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের গত ৪ দিনের পরিসংখ্যান একই থাকার মানে হচ্ছে, এ দেশে করোনা পরিস্থিতি একই রকম আছে। এই একই রকম করোনা পরিস্থিতি থাকার মানেই হলো, বাংলাদেশ এখনও করোনার পিক সময় অর্থাৎ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেনি। এখন যদি আমরা আরও কিছুদিন লকডাউন বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অক্ষুন্ন রাখতে পারতাম, তাহলে এই করোনা পরিস্থিতির লাগামটা হয়তো আমরা টেনে ধরতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই সেই সুযোগটা হারিয়েছি। এখন যেভাবে ঢাকার মধ্যে লোকজন ঢুকছে, গার্মেন্টস কারখানা ও হোটেল-রেস্তোরাসহ সবকিছু খুলে দেয়া হচ্ছে এবং মানুষ অবাধে মেলামেশা করছে, তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে পরিস্থিতি যদি খারাপ হয়, তাহলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ আমাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার যে সময়সীমাটা ছিল, সেটা আমরা সঠিকভাবে প্রতিপালন করিনি।
এ প্রসঙ্গে একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬০তম দিনে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে ৬০তম দিন আসার এখনও ৮ দিন বাকি আছে। আগামী এই ৮টা দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ৮ দিনের মধ্যে যদি আমরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার বিধি নিষেধগুলোকে মানতে না পারি, তাহলে আমাদের জন্য খুব খারাপ খবর অপেক্ষা করছে।
আরেকজন বিশেষজ্ঞ হতাশার সুরে বলেছেন, কেউ আসলে কিছুই মানছে না। যার যা ইচ্ছা তাই করছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস খুলে দেয়া এবং অন্যান্য অনেক কিছু খুলে দেয়ার ফলে বাংলাদেশে সামাজিক সংক্রমণের ব্যাপক বিস্তৃতির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মনে রাখতে হবে, ঢাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। যখন ঢাকার লকডাউন উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট চালু করা হচ্ছে, গার্মেন্টস খুলে দেয়া হচ্ছে, তখন ঢাকার পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে কী ভয়ঙ্কর হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে।


বিজ্ঞাপন