আক্রান্তের সর্বোচ্চ রেকর্ড

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

করোনার পিছে পিছে হাঁটছে বাংলাদেশ
এখনও আগের মতোই শক্তিশালী করোনা

 

মহসীন আহমেদ স্বপন : বিশ্বব্যাপী মহামারি রূপ নেয়া করোনাভাইরাসে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশেও প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড ভাঙছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ২ হাজার ৯১১ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৫২,৪৪৫ জনে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৭ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭০৯ জনে।
দুই মাসের বেশি চলা সাধারণ ছুটির পর তৃতীয় কর্মদিবসে মঙ্গলবার দুপুরে করোনা ভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা।
তিনি সবাইকে স্বাস্থ্য পরামর্শ মেনে ঘরে থাকার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি পুষ্টিকর খাবার গ্রহণেরও পরামর্শ দেন। একই সাথে যারা করোনার এই মহামারিতে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের ধন্যবাদ দেন নাসিমা।
তিনি আরও বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরও ৫২৩ জন। এ নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১১ হাজার ১২০ জনে।’
নতুন করে যারা মারা গেছেন, তাদের ৩৩ জন পুরুষ এবং চারজন নারী। এদের মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন ২৮ জন এবং বাসায় মৃত্যু হয়েছে নয় জনের। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৫ জন, সিলেট বিভাগের চারজন, বরিশাল বিভাগের তিনজন, রাজশাহী বিভাগের দুজন, রংপুরের দুজন এবং ময়মনসিংহ বিভাগের একজন রয়েছেন। বয়সের দিক থেকে ২১ থেকে ৩০ বছরের একজন, ত্রিশোর্ধ্ব চারজন, চল্লিশোর্ধ্ব একজন, পঞ্চাশোর্ধ্ব ১০ জন, ষাটোর্ধ্ব নয়জন, সত্তরোর্ধ্ব ১০ জন এবং ৮১ থেকে ৯০ বছরের দুজন মারা গেছেন।
এর আগে সোমবারের বুলেটিনে জানানো হয়, দেশে চব্বিশ ঘণ্টায় আরো ২৩৮১ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯,৫৩৪। এ সময়ের মধ্যে মারা গেছেন আরো ২২ জন। সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ৬৭২।
সোমবারের ব্রিফিংয়ে আরো জানানো হয়, সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫২টি পরীক্ষাগারে ১১ হাজার ৪৩৯টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০ দশমিক ৮১ শতাংশ। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় সুস্থতার হার ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ, মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
করোনাভাইরাস মূলত শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এর লক্ষণ শুরু হয় জ্বর দিয়ে, সঙ্গে থাকতে পারে সর্দি, শুকনো কাশি, মাথাব্যথা, গলাব্যথা ও শরীর ব্যথা। সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্ট। উপসর্গগুলো হয় অনেকটা নিউমোনিয়ার মত। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে এ রোগ কিছুদিন পর এমনিতেই সেরে যেতে পারে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্র বা ফুসফুসের পুরোনো রোগীদের ক্ষেত্রে ডেকে আনতে পারে মৃত্যু।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্ত হলেও প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। দিন দিন করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় নড়েচড়ে বসে সরকার। ভাইরাসটি যেন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব সরকারি-বেসরকারি অফিস। কয়েক দফা বাড়িয়ে এ ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়।
ছুটি শেষে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই ৩১ মে থেকে দেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস খুলে দেয়া হয়। তবে বন্ধ রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ধীরে ধীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে বলে রোববার জানান প্রধানমন্ত্রী।
করোনার পিছে পিছে হাঁটছে বাংলাদেশ : কোভিড মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেও এখনো ভাইরাসের পেছনেই হাঁটছে বাংলাদেশ। আর এ অবস্থার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে কালক্ষেপণ এবং বাস্তবায়নে তদারকির অভাবকে দুষছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অভাব আছে নেতৃত্বের। দরকার সমন্বয় নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সময় লাগলেও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আরো কঠোর হবে সরকার।
অবশেষে কোভিড মোকাবিলায় এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার কথা ভাবছে সরকার। সে অনুসারে রেড, গ্রিন, ইয়েলো এই তিন জোনে ভাগ করে নেয়া হবে ব্যবস্থা। অথচ রোগীর সংখ্যা যখন হাজারের নিচে তখনই এমন পরিকল্পনার কথা বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তাই তারা বলছেন, সিদ্ধান্ত সঠিক হলেও সময় মতো ট্রেন ধরতে পারেনি বাংলাদেশ।
অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ বলেন, আমরা যদি আইশোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরি টেস্টের কথা চিন্তা করি, আমরা দেখছি সব কাজ পরে করা হচ্ছে। সময়ের সামনে যদি হাটতে পারতাম তাহলে এই লকডাউনের সফলভাবে ইতি টানতে পারতাম।
ডা. মোহাম্মদ জাকের উল্লাহ বলেন, লকডাউন খোলার আগে পরিকল্পনা না করে পরে যদি পরিকল্পনা করা হয় তাহলে সংক্রমণের হার অনেক বেশি বেড়ে যায়। দেখতে পাচ্ছি করোনা আমাদের আগে হাঁটছে, অথচ আমাদের হাটতে হবে করোনার আগে।
তবে এখনো ফুরিয়ে যায়নি সময়। পরিকল্পনা কাগজ থেকে দ্রুত বাস্তবায়নে রূপ দেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন তারা। নিশ্চিত করতে হবে দক্ষ মনিটরিং টিমও।
এরমধ্যেই স্বাস্থ্য বিভাগ একটি ভাল পরিকল্পনা করতে পারতো।
কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিস্থিতি অনুসারে ব্যবস্থা নেবেন তারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, যখন সংক্রমণের পর্যায় ছিল অল্প তখন সরকার একপেক্ষী ব্যবস্থা নিয়েছে। আর এখন যখন নেগেটিভলি বেড়েছে সেক্ষেত্রে কেউ নির্দেশনা না মানলে কঠোর তো হতেই হবে। সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সহায়তাও জরুরি।
এখনও আগের মতোই শক্তিশালী করোনা: বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখনও দুর্বল হয়নি। আগের মতোই বিপজ্জনক রয়েছে ভাইরাসটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তড়িঘড়ি লকডাউন তুলে নেয়ার তোড়জোড়ের সময় এই সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
সম্প্রতি ইটালির এক প্রথম সারির চিকিৎসক দাবি করেন, সে দেশে আর করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব নেই। ভাইরাসটির মারণ ক্ষমতা এখন আগের তুলনায় অনেকটা কম। তাছাড়া আগের তুলনায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।
অ্যালবার্টো জাংগ্রিল নামের ওই চিকিৎসকের দাবি, ‘ইতালিতে এই ভাইরাসের আর অস্তিত্ব নেই। শেষ দশদিন যে লালারসের নমুনা আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যাচ্ছে দু’মাস আগের তুলনায় ভাইরাসটির পরিমাণ নেহাতই নগণ্য।’
চিকিৎসকের এই দাবিতে শোরগোল পড়ে যায় বিশ্বের চিকিৎসক মহলে। যার প্রেক্ষিতে এই সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে বাধ্য হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সোমবার সংস্থার জরুরি বিভাগের কর্মকর্তা মাইকেল রায়ান বলেন, ‘আমাদের আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। এটা একটা মারাত্মক ভাইরাস। ভাইরাসটি হঠাৎ স্বেচ্ছায় শক্তিক্ষয় করে আগের তুলনায় দুর্বল হয়ে গেছে এবং আগের থেকে কম মারাত্মক হয়ে গেছে, এই ধরনের চিন্তাভাবনা একেবারেই ঠিক নয়।’
ডব্লিউএইচও মনে করছে, কেবল গোটা বিশ্ব নয়, ইতালিতেও করোনাভাইরাস আগের মতোই বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, ডব্লিউএইচও আগেই জানিয়েছিল, লকডাউন শিথিল করার ক্ষেত্রে ‘চূড়ান্ত নজরদারি’জরুরি। একই সঙ্গে সংস্থাটি তাড়াহুড়ো করে বিধিনিষেধ শিথিল না করারও পরামর্শ দিয়েছিল। পাশপাশি লকডাউন তোলার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন না করলে ফের দ্রুতগতিতে ছড়াতে পারে করোনা।
কিন্তু সম্প্রতি দেখা গিয়েছে ইটালিসহ গোটা ইউরোপেই আগের তুলনায় করোনার প্রভাব খানিকটা কম। এবং সেকারণেই ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে গোটা ইউরোপ।


বিজ্ঞাপন