ঐতিহাসিক ৬ দফা বাঙালির মুক্তির সনদ

অন্যান্য জাতীয় বিবিধ

এইচ এম মেহেদী হাসান

 

স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ যদি চাষ হয়ে থাকে ১৯৫২ সালে, তবে সেই বীজ মাটি ফুঁড়ে দৃশ্যমান হয়েছিল ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে তাঁর প্রণীত ছয় দফার মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ এবং বাঙালি জাতির এক অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও জাতিসত্তার প্রতীক। তা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সাহস,বাগ্মিতা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ঐদিনই পরিলক্ষিত হয়েছে, কারণ তিনি বাঙালির মনোভাব বুঝতে পেরেই সেদিন অনেক রাজনৈতিক সহকর্মীর আপত্তি সত্ত্বেও বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা প্রণয়ন করেছিলেন। বাঙালির এই মুক্তির সনদ ৬ দফার প্রতিটি শব্দের সাথে মিশে আছে ছাত্রলীগের ঘাম ঝরানো ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য ছাত্রলীগকে গুরুদায়িত্ব দেয় এবং ছাত্রলীগ প্রতিটি ঘরে ঘরে ৬ দফার মর্মবাণী পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়। ছাত্রলীগের কাছে ৬ দফা হয়ে ওঠে অলিখিত গঠনতন্ত্র। তাই যেকোনো মূল্যে ৬ দফা বাস্তবায়নই হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের মূল লক্ষ্য।
এখানে আরেকটু কথা বলে রাখি স্কুলে ছোট-বড় সকলেই তাঁকে ‘মিয়াভাই’ বলে ডাকতো। কিশোর শেখ মুজিব নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত বাঙালির পাশে থেকে পরিণত হয়েছেন-একজন ছাত্রনেতা থেকে প্রাদেশিক নেতা। প্রাদেশিক নেতা থেকে জাতীয় নেতা। জাতীয় নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা। কালজয়ী মহাপুরুষ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।
১৯৬৬ সালের ৭ ই জুন বাংলার গণমানুষের স্বাধিকার ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক হরতাল পালন করেছিল। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামীর শৃঙ্খলে চিরস্থায়ীভাবে শৃঙ্খলিত করার জন্য যে ষড়যন্ত্র করেছিল, তার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ -এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধীদলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলা’র গণমানুষের স্বাধিকারের দাবি সম্বলিত বাঙালির ‘ম্যাগনাকার্টা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জানালে ফেব্রুয়ারির ১১তারিখ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ও ২০ফেব্রুয়ারি তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ডেকে ছয় দফা অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেন। অত:পর ফেব্রুয়ারির ২০তারিখে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক ছয় দফা দলীয় কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ছয় দফা প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট উপ-কমিটি গঠন করা হয় এবং তাঁরই নামে পুস্তিকাটি মুদ্রিত হয়। একই বছরের মার্চের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। ছয় দফা কর্মসূচী দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’
ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে ৬৬- এর মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ। সেদিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ছয় দফার ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করে। ছয় দফা কর্মসূচি প্রদানের সাথে সাথে ছয় দফার ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল।
আওয়ামী লীগের এ কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন যা ৬৯- এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপোষ নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়, এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ। ‘স্বভাবসুলভ কন্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলবো। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানতেন ছয় দফাই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করে অখন্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবীরা ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, দফা হিসেবে ছয়টি হলেও বাঙালির স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটি মানুষই বুঝতে পেরেছিল দফা আসলে একটিই। সেটি হলো, স্বাধীন বাংলাদেশ। তিনি নিজেও আপনজনদের কাছে অনেকবার খোলামেলাভাবেই এ কথা বলেছেন। প্রবীণ বামপন্থি রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক লেখক, ইতিহাসবিদের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন সত্যতা স্বীকার করেন।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ এর উদ্ধৃতির আলোকে
৬ দফা পরিকল্পনা পেশের সময় শেখ মুজিবুর রহমান তাকে এবং রুহুল কুদ্দুস নামক একজনকে ডেকে বলেছিলেন, আসলে এটা ৬ দফা নয়, এক দফাই। ঘুরিয়ে বললাম শুধু।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপিত ঐতিহাসিক ছয় দফা হলো –
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্যসহ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২. বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশের হাতে ন্যস্ত থাকবে। উল্লিখিত দুটি বিষয় ন্যস্ত থাকবে কেন্দ্রীয় বা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে।
৩.পাকিস্তানের দুটি অঞ্চলের জন্য পৃথক অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে। অথবা সমগ্র দেশে একটি মুদ্রাব্যবস্থা থাকবে,তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য একটি ফেডারেলের ব্যাংকের অধীনে কার্যকরী ব্যবস্থা করতে থাকতে হবে।
৪. অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে। তবে ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এর একটি অংশ পাবে।
৫. পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা স্ব-স্ব অঞ্চলের বা অঙ্গরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঞ্চলিক সরকার বিদেশে বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং যে কোনো চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।
৬. নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গরাষ্ট্রসমূহ প্যারামিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে পারবে।
ছয় দফা প্রণয়নের পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর ওপর অত্যাচার -নির্যাতন আর হয়রানির খড়গ নেমে আসে। বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সফর সঙ্গীসহ উত্তরাঞ্চলে যান ৬৬-এর ৭ এপ্রিল। ঐদিন পাবনায় এক বিরাট জনসমাবেশে তিনি বক্তৃতা করেন। অত:পর ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধুর ঝটিকা সফরে ছয় দফার সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর নেমে আসে নির্মম গ্রেফতার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারীকৃত ওয়ারেন্ট বলে গ্রেফতার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এপ্রিলের ১৭তারিখ রাত্রি ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণ দান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারীকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশ রক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান। এরপর সেদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেফতার, পুনরায় জামিনের আবেদন, ২৩তারিখ জামিন লাভ। ২৪এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেফতার, ২৫এপ্রিল জামিন। এভাবেই আইয়ুবের দমননীতি চলতে থাকে। একই বছরের ৮মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনসভার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২(১) ক ধারা বলে তাঁকেসহ তাঁর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেফতার করে। ছয় দফা দেওয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরপর দেশরক্ষা আইনের আওতায় চলতে থাকে আওয়ামী লীগের উপর অব্যাহত গ্রেফতার-নির্যাতন।
সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ছয় দফার প্রতি মানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। কয়েক সহস্র শ্রমিক এদিনে স্বত:স্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমননীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। এর পরপরই দলের নব-নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে গ্রেফতার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ীভাবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৭জুন হরতাল আহবান করা হয়। ৭জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ সেদিন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই কারাগারে বন্দী। সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার নেতা ও কর্মী কারাগারে। শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে। বাকী নেতা-কর্মীদের উপর হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরোয়ানা। দোর্দ-প্রতাপ আইয়ুব ও মোনেম খানের।
এই দিকে ৬ দফা দাবিকে আরও বেগবান করতে ছাত্রলীগের মমতাময়ী অভিভাবক বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রনেতাদের অনুপ্রাণিত করেন ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে। তিনি দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে অপরিসীম ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬ সালের ঘটনা, ছাত্রলীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক সংগঠন চালাতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে খুব নাজুক পরিস্থিতিতে পতিত হন। তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে তিনি হেঁটে ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের শরণাপন্ন হলেন। তিনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে লিফলেট ছাপানোর জন্য ৫০টাকা চাইলেন। সে সময় বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে বাজার-সওদার খরচ বাবদ ৫০টাকাই ছিল। তিনি নির্দ্বিধায় পুরো টাকাই তুলে দিলেন আবদুর রাজ্জাকের হাতে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে ছাত্রলীগ নেতারা যতবারই দেখা করতে যেতেন, ততবারই তিনি সাক্ষাতের মূল কারণগুলো শুনে প্রয়োজন মিটিয়ে বিদায়বেলায় পরামর্শ দিতেন- আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি ভালো ফল করার। তিনি বলতেন, ওটা করলে তোমার সব দরজা খুলে যাবে, রাজনীতিরও। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে পাশে পেয়ে ছাত্রলীগ সব অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে রাজপথে থেকেছে সবসময়।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৬৬ -র ৭জুনের সঙ্গে সরাসরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। তিনি তখন ইকবাল হল (বর্তমান শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি)। তখনকার সময় ইকবাল হল থেকেই হরতালকে সফল করার জন্য সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। শেখ ফজলুল হক মণি, যিনি ৭জুন আন্দোলনের মূল নেতা ছিলেন। তিনি আর তোফায়েল আহমেদ একই কক্ষে থাকতেন। বলে রাখা ভালো তখন ফজলুল হক মণি ছাত্র নন।
মাত্র ১৪জনকে নিয়ে ফজলুল হক মণি বসলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখানে বসে দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করার অগ্রভাগে তখনকার ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। ৭জুনের কর্মসূচিকে সফল করতে সব প্রস্তুতি নিয়েছিলেন এবং সফল হলেন। শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদসহ অনেকে হরতাল পালনের প্রস্তুতি নেওয়ার প্রাক্কালে অর্থাৎ শেখ ফজলুল হক মণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসে ছিলেন হরতালের সপক্ষে প্রচার চালানোর জন্য। তিনি তখন ছাত্র নন। ড.ওদুদুর রহমান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ছিলেন। তিনি শেখ মণিকে বললেন, মণি, তুমি এখন ছাত্র নও। তুমি ক্যাম্পাসে অবস্থান কোরো না, চলে যাও। তুমি যদি না যাও তবে আমার চাকরি যাবে।
শেখ মণি তখন স্যারের কথায় সবিনয়ে সম্মতি জানিয়ে ছাত্রনেতাদেরকে হরতাল কর্মসূচি যথাযথভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন তেজগাঁর শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, আবুল হোসেন এবং আদমজীর মজিবুলসহ ১১জন শ্রমিক। প্রায় আটশ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তাঁরা সেখানে বক্তৃতা করেন। ৭জুনের সফল হরতালে আতঙ্কিত হয়ে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান, বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এ চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ৭জুন ছিল স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর ঐ সময়ে যারা ছাত্রলীগ করতেন, তাঁদের কাছে রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতেই।
১৯৫২ -এর ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ৭ জুনে ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪জানুয়ারির গণআন্দোলন-অণঅভ্যুত্থান। ৯ফেব্রুয়ারি ১১দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে শপথ দিবস পালন। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর নি:শর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ঘন্টার আল্টিমেটাম প্রদান। অত:পর ২২ফেব্রুয়ারি সকল রাজবন্দীর মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ। ২৩ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করেন, ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্রসমাজ এবং আপামর জনসাধারণের পক্ষে তখনকার তুখোড় ছাত্রনেতা ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্রলীগ।
৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের পরে তোফায়েল আহমেদকে সভাপতি ও আসম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়েছিল। অবশ্য এর আগেই ছাত্রলীগের সভাপতি মাযহারুল হক বাকী এবং সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ১৯৬৭-৬৮ সালের মধ্যেই ৬দফাকে ছাত্রদের প্রাণের দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক ৬ দফাভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই ধাপে ধাপে বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামে পরিণত করে। ৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে
অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগকে জনগণ নিরঙ্কুশ বিজয়ী করলেও স্বৈরাচারী পাকিস্তানি শাসকেরা বিজয়ী দল আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে না দিলে আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেন। বলে রাখা ভালো ৬৬-এর সাতই জুন ঐতিহাসিক ৬ দফাই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা, আর বঙ্গবন্ধুও জানতেন ক্ষমতা নিয়ে টালবাহানা শুরু হবে, তিনি এ জানতেন নির্বাচনে কি ফলাফল আসবে। তিনি ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন, তাঁকে কে কি বুঝাবে? বঙ্গবন্ধু ৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে একটু ঝালাই করে নিলেন আসলেই কি মানুষ তাঁকে চায়,না কি অন্য কাউকে,তিনি জানতেন তাঁর বাঙালি তাঁর-ই আছে।
আর সেটা নির্বাচনেই প্রমাণ হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধুর একটাই লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা। এরই ধারাবাহিতায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের।
লেখক : কলামিষ্ট, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ সভাপতি।


বিজ্ঞাপন