কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী

এইমাত্র জাতীয় রাজধানী রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : মাত্র কয়েক ঘণ্টা ব্যবধানে পর পর দু’জন বিশস্ত সহযোদ্ধাকে হারিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুব দুঃখজনক। এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপ হয়ে যান, এসময় প্রধানমন্ত্রীকে কাঁদতে দেখা যায়। এরপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আসলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বলতে। দু’জনকে হারানো খুবই দুঃখজনক।
রোববার দুপুরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে একাদশ সংসদের ৮ম অধিবেশনে মোহাম্মদ নাসিম ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে এভাবেই আপ্লত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় উপস্থিত সব সংসদ সদস্য স্তব্ধ হয়ে যান। নিরবতা নেমে আসে অধিবেশনে। টিভির পর্দায় দেখা যায় প্রধানমন্ত্রী তার মুখের মাস্কটি দিয়ে মুখ ঢেকে কাশি দিচ্ছেন। আবারও গলা ধরে যায় তার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চেয়েছিলাম, বাংলাদেশে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকুক এবং তা আছেও। অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে যাচ্ছিলাম। জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। দেশের মানুষ একটা সুন্দর জীবন পাবে, অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বার বার আঘাত পেতে হচ্ছে, এ কথা বলেই চুপ হয়ে যান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ মরণশীল। একবার জন্মগ্রহণ করেছি, মৃত্যু অবধারিত, সবার জন্য এটা প্রযোজ্য, এটা হবেই। যখন একটা কাজ করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এবং আমাদের আশা ছিল আমরা মুজিববর্ষ উদযাপন করব, দেশের দারিদ্র্যসীমা আমরা কমিয়ে এনেছি, কোথায় ৪০ ভাগ ছিল, সেটাকে ২০ ভাগে নামিয়ে আনতে পেরেছি, মাত্র ১০ বছরের মধ্যে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি, আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছিলাম, ঠিক তখন এমন একটা অদৃশ্য শক্তি করোনাভাইরাস, যা কেউ চোখেও দেখতে পারে না, বুঝতেও পারে না, সারা বিশ্বটাকে স্থবির করে দিল। সারা বিশ্বে যেন কেমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করল। আমাদের আওয়ামী লীগের একজন কর্মীও যেখানে মারা গেলে, আমরা সবাই ছুটে গেছি, জানাজা পড়া, শ্রদ্ধা জানানো, পরিবারের সাথে দেখা করা, কিন্তু এমন একটা অস্বভাবিক পরিবেশ যে আমরা এবার করতে পারলাম না। কাউকে দেখা বা তার পরিবারকে সান্তনা দেওয়া বা তাদের সঙ্গে একটু কথা বলার সুযোগটাও কেন যেন পেলাম না, সেটাই সব থেকে কষ্ট। একটা আতঙ্ক, ভয়, ভীতি, মৃত্যু আতঙ্ক যেন সারা বিশ্বকে পেয়ে বসেছে। এটাই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, আমি জানি না, এ ধরনের পরিবেশ আগে কেউ আর কখনো দেখেনি।
করোনার কারণে রোববার সংসদের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেতে বাধা দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, সংসদে আসব অনেক জায়গা থেকে কিন্তু আমাকে ভীষণভাবে বাধা দেয়া হয়েছে, নিষেধ করা হয়েছে। বলেছে-নেত্রী আপনি যাবেন না। আমি বললাম গুলি, বোমা, গ্রেনেড কত কিছুই তো মোকাবিলা করে এ পর্যন্ত এসেছি। আর একটা অদৃশ্য শক্তি তার ভয়ে ভীত হয়ে থাকবো?
এসময় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহর মৃত্যুতে তিনি শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যের হার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই আমরা কমিয়ে এনেছি। আমাদের জিডিপি বেড়ে গিয়েছিল। আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছিলাম। কিন্তু এমন একটা অদৃশ্য শক্তি করোনাভাইরাস সারাবিশ্বটাকে স্থবির করে দিয়েছে। সারাবিশ্বটাতে কেমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করলো। আমাদের কোনো নেতাকর্মী মারা গেলেও আমরা ছুটে গেছি তার জানাজায়, কবরে ফুল দেয়া ও পরিবারের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এখন এমনই অস্বাভাবিক পরিবেশ যে আমরা এবার সেটা করতে পারলাম না। সেটাই হলো সবচাইতে বড় কষ্টকর। একটা আতঙ্ক, ভয়-ভীতি যেন সারাবিশ্বকে পেয়ে বসেছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি অন্ততপক্ষে দেশের মানুষ যেন স্বাস্থবিধি মেনে চলে। পাশাপাশি করোনার ভয়ে মানুষগুলোকে তো না খেয়ে মারতে পারি না। এটা হলো বাস্তবতা। তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা তো আমাদের নিতে হবে। তাদের জীবনযাত্রা যেন চলে সেই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। অথচ এই আতঙ্কটা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যেটা সত্যি খুব দুঃখজনক। তবে আমরা ঠিক করেছি কোন কোন এলাকায় বেশি করোনাভাইরাস দেখা যাচ্ছে সেটা লকডাউন করা।
শেখ হাসিনা বলেন, যাতে সেখান থেকে কোনোরকম আর সংক্রমিত না হয়। সাথে সাথে যেন আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল থাকে সেদিকেও আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। এটা এক ধরনের যুদ্ধ। এই সময় আমাদের দুজন হারালাম যারা সবসময় আমাদের সাথে ছিল। তাদের হারানোটা অত্যন্ত কষ্টকর। আমি তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
একই দিনে পরপর দু’জনের মৃত্যু খুবই কষ্টকর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়াত দুই নেতাকে স্মরণ করে বলেছেন, একই দিনে পরপর দু’জনের মৃত্যু খুবই কষ্টকর। আমাদের এই সংসদে বারবার শোক প্রস্তাব আনতে হচ্ছে। শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি দুই নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর মৃত্যুতে রোববার সংসদে শোক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। এর আগে সব প্রস্তাবের ওপর সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। এসময় তিনি এসব কথা বলেন।
দুই নেতাকে স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি দেশে ফেরার পর পদে পদে আমাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এসময় যে দু’জনকে আমি সব সময় পাশে পেয়েছি একই দিনে তাদের হারালাম।
মোহাম্মদ নাসিম ওয়ান ইলেভেনের সময় কারাগারে থাকা অবস্থায় স্ট্রোক করেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় কারাবন্দি সালমান এফ রহমানের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স সব সময় জেলগেটে তার পরিবারের পক্ষ থেকে রাখা থাকতো। ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে মোহাম্মদ নাসিমকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয় বলে তিনি সেই যাত্রায় বেঁচে যান। তবে ওই সময় তার শরীরের একপাশ প্যারালাইজড হয়ে যায়।
শোক প্রস্তাবের আলোচনাকালে শেখ হাসিনা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, করোনা এমন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে আমাদের দলের কেউ মারা গেলে তার পরিবারের কাছে ছুটে যাবো, একটু সান্ত¡না দেবো, সেই সুযোগ পাচ্ছি না। আজ সংসদে আসার সময় আমাকে অনেক জায়গা থেকে সংসদে না আসতে নিষেধ করা হয়েছে।
বিশ্বের করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস আক্রান্ত উন্নত-অনুন্নত দেশের সবাই ভয়ে আছেন। এই আতঙ্কটা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যেটা দুঃখজনক। তবে যে এলাকাটায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে লকডাউন করছি। মানুষের জীবনযাপন যেন স্বাভাবিক থাকে সেই ব্যবস্থা নিয়েছি।
শোক প্রস্তাবের ওপর অন্যদের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের, শেরপুর-২ আসনের বেগম মতিয়া চৌধুরী, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের মৃণাল কান্তি দাস, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের ডা. হাবিবে মিল্লাত, ঢাকা-৫ আসনের কাজী ফিরোজ রশীদ ও সাতক্ষীরা-২ আসনের মুস্তফা লুৎফুল্লাহ।
পরে মরহুম দুই নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সংসদে দোয়া মোনাজাত পরিচালনা করা হয়। এর আগে তাদের স্মরণ করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া মোনাজাত পরিচালনা করেন।
চলতি সংসদের কোনও এমপি মারা গেলে সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী ওই সংসদ সদস্যকে স্মরণ করে সংসদে আলোচনা হয়। পরে বৈঠক সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।


বিজ্ঞাপন