লকডাউনের কথা

অন্যান্য অপরাধ বিবিধ সারাদেশ

মোহাম্মদ নুরে আলম সোহেল: সেদিন আমি লকডাউন নিশ্চিতের জন্য কাজ করছিলাম! একটি গাড়ী সিগন্যাল দিয়ে আটকানো হলো! সেই গাড়ীতে মাঝ বয়সী ৩ জন পুরুষ আছে! আমার পুলিশ প্রথমে জিজ্ঞেস করায় তারা একটু খারাপ ব্যবহার শুরু করলো! এক পর্যায়ে কনষ্টবলেরা আমার কাছে তাদের তিনজনকে ধরে নিয়ে আসলো! আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা ৩ জন সম্পর্কে কি হন? তারা আমায় বললো, তারা আত্নীয়! তারপর আমি কৌশলে তাদের কাগজপত্র চেক করে ও জিজ্ঞাসাবাদে বুঝতে পারলাম, তারা আসলে আত্নীয় নন এবং এক এলাকারও নয় ! তখন তারা এক পর্যায়ে তিন জনই আমার কাছে সত্য স্বীকার করতে বাধ্য হন! তখন আমি তাদের বললাম যখন এত বড় একটা মহামারি করোনা ঢাকায় চলছে, কেন আপনারা এই ঈদের আগের দিন ঢাকায় যাচ্ছেন? এতে আপনিও আক্রান্ত হতে পারেন এবং আপনার পরিবার পরিজনও আক্রান্ত হতে পারে ! যে টাকা উপার্জনের জন্য আজ আপনি ঢাকায় যাচ্ছেন, এতে আপনিও মরবেন, সাথে আপনার পরিবার পরিজন মরবে ! টাকা উপার্জন করে যে পরিবারকে আজ আপনি বাঁচাতে ঢাকায় যাচ্ছেন, আপনি মরে গেলে তো সেই ছেলে মেয়েগুলো এতিম হয়ে যাবে? আপনারা বেআইনীভাবে একই সাথে দুটো অপরাধ করেছেন! তাই এখন আমি আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা দেবো! তখন তারা আমায় যা বললো, তাতে আমার চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না! একজন বললো স্যার আজ আমার অবুঝ সন্তানটি দুই দিন ধরে না খেয়ে আছে! আমার অবুঝ শিশুটি যদি ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরিয়ে আমার সামনে না খেয়ে থাকে, বাবা-মা ডাক ছেড়ে খাবার দাও বলে চিৎকার করে, তখন আমি কি ঠিক থাকতে পারি? তখন আমার তো আত্মহত্যা করা উচিত ছিলো স্যার ! তাই স্যার, আমি ঈদের আগের দিন, ঈদের খুশি বাদ দিয়ে ঢাকায় কাজের খোঁজে যাচ্ছি! তার কথাগুলো শুনছিলাম, আর তখন আমার অবুঝ সন্তান আহনাফের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো! হায়… আজ যদি আমার সন্তান না খেয়ে থাকে তবে তো আমিও পাগলের মতো হয়ে যাবো! তারা আমার পায়ে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইতে এগিয়ে আসছিলো ! আমি তাদের সন্মান করে সরিয়ে দিয়ে বললাম, এবার আমি যা যা জিজ্ঞেস করবো সত্য করে বলবেন! তাদের কথা শুনে ইচ্ছে হচ্ছিল যদি আল্লাহ আমায় আজ কোটিপতি করতো তবে আমি তাদের আজই তিন জনকে ৩ লক্ষ টাকা করে দিয়ে দিতাম! আর বলতাম আজ থেকে ঘরে বসে বসে খান, আর ঘর থেকে বের হবেন না! কান্না করতে থাকা ব্যক্তি তিনটিকে দূর থেকে সান্ত্বনা দিলাম! চলন্ত রাস্তায় খাবারের জন্য তাদের কিছু টাকা দিলাম। দুইজন নিলো, একজন নিলো না! কান্না জড়িত কন্ঠে, বললো স্যার আমাদের এবারের মতো মাফ করে ছেড়ে দিন! আমাদের জেলে দিয়েন না! মাফ তো তাদের আমি মন থেকে মানবিকভাবে বহু সময় আগেই করে দিয়েছি! কিন্তু তখনও নিজেকে মাফ করতে পারছিলাম না! আজও সেই অব্যক্ত কষ্ঠে নিজেকে মাফ করতে পারিনি..!!তখন ভাবলাম, আজ আমার সামনে যে অসহায় পিতা তার সন্তানের প্রতি এত বড় মমতা দেখালো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে চাইলো, সেই পিতার প্রতি কি আমি আমার সীমিত সাধ্যে সম্পূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? পেরেছি কি আমার নিজস্ব সম্পদ দিয়ে হলেও তাদের পরিবারকে আরও সাহায্য করে আমার পুরোপুরি মানবিক দায়িত্বগুলো পালন করতে? যদি আজ আমি তাদের আরও জরিমানা করি (পারবো হয়তো) তবে তারা আরও ব্যপক ক্ষতির মুখে পড়বে! আবার মানবিকভাবে বাঁচানোর কথাও সংবিধানে বলা আছে! আজ যেই সমাজ পরদিন তাদের আর কোন খোঁজ না নিয়ে যে চরম অবহেলা করেছে, সেই সমাজ কি পারবে কোনদিন তার সমাজপতিদের এ অপরাধের দায় শোধ করতে? নিজের অসহায়ত্বে কথা ভেবে আমার চোখের জল টিপ টিপ করে গড়িয়ে পড়লো! কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না! অবাক চোখে সিপাহিকে তাদের ছেড়ে দিতে হাত দিয়ে ইশারা দিলাম… তারা চলে গেলো! আমি চোখের জল মুছে নির্বাক হয়ে তাদের দিকে অপলক চেয়ে রইলাম।


বিজ্ঞাপন