যে কৌশলে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ

এইমাত্র জাতীয় রাজনীতি

বিশেষ প্রতিবেদক : মহামারী করোনাভাইরাস কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। আক্রান্ত ও মৃত্যুর তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন মন্ত্রিসভার সদস্য, সাংসদসহ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারাও। এত দিন চিকিৎসক, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ তুলনামূলক বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলেন। কিন্তু এখন বিশিষ্টজনদের আক্রান্ত হওয়া এবং কারও কারও মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে। নিজের ও পরিবারের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাঁরা।
করোনাকালীন এই সঙ্কটে দেশের মানুষের পাশে থাকতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুচ্ছেন বিশেষ কৌশল নিয়ে। যদিও সরকার এবং দলকে আলাদা করার নীতি এবং কৌশল নিয়ে আগেই পথচলা শুরু করেছিলেন শেখ হাসিনা। কৌশলের এই অংশ হিসেবেই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়গুলো দেখভাল করছেন বিশেষ করেকজন নেতা। এরাই এখন সারাদেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাদেরকে করোনা সম্বন্ধে নির্দেশ দিয়েছেন, বিশেষ করে ত্রাণ বিতরণ, মানুষকে সচেতন করাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক উদ্যোগের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে যাচ্ছেন তারা। যদিও এসব নেতারা সরকারে নেই।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আব্দুর রহমান, মির্জা আজম, বিপ্লব বড়ুয়া। দলীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। যিনি করোনা সংক্রমনের শুরু থেকেই দলীয় কার্যালয়ে বসছেন এবং ধীরে ধীরে দলের কার্যক্রমকে সক্রিয় করছেন। সারাদেশে যেন নেতাকর্মীরা দুর্গত মানুষের পাশে দাড়ায়, ত্রাণ বিতরন করে সেজন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। করোনা সঙ্কটের শুরু থেকেই তিনি দলের নেতাকর্মীদের, বিশেষ করে বিভিন্ন অঙ্গসহযোগি সংগঠনগুলো যেন কাজ করে, গরীব মানুষের পাশে দাঁড়ায় সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে ধান কাটার সময় আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ী অঙ্গ সহযোগি সংগঠনগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন কৃষকদের সঙ্গে তারাও যেন কাজ করে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমানকেও নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে দেখা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং বাহাউদ্দীন নাছিমের সঙ্গে তিনিও দলীয় কর্মকা-ে সহযোগিতা করছেন।
মির্জা আজম এমপি এলাকাতেই করোনা মোকাবিলায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কিন্তু ঢাকাতেও তিনি সার্বক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করছেন। সারাদেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের যে বিভিন্ন সমস্যা, আওয়ামী লীগের মধ্যেও যে অনেকের অভাব অনাটন রয়েছে সে বিষয়গুলো তিনি দেখভাল করছেন। সারাদেশে সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এই সাংগঠনিক সম্পাদক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা বিপ্লব বড়ুয়া। একাধারে দলের তথ্য সম্পাদক, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী- এই বিবেচনায় তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দলের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। দলের সিদ্ধান্তও তিনি সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সারাদেশে যেন তা প্রতিপালিত হয় তা লক্ষ্য রাখার কাজটিও করছে আওয়ামী লীগের এই তরুণ নেতা। সাংগঠনিক বিষয়গুলো দেখভালের জন্য তারাই দলের মধ্যে নিউক্লিয়াস হয়ে উঠেছে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানাচ্ছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রবীন নেতা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিলো-রাজনৈতিক দল ও সরকার আলাদা থাকবে। সেই কৌশলের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের স্বার্থে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেছিলেন। দলের জন্য সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন। সে সময় আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে ছিলো যে, যারা মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করবেন তারা দলের নেতৃত্বে থাকবেন না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর আওয়ামী লীগের এক দু:সময় এসেছে। ১৯৮১ সালে এক ভঙ্গুর বিধ্বস্ত দলের দায়িত্ব তুলে নেন শেখ হাসিনা। তারপর তিল তিল করে তিনি দলটিকে গুছিয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময় শেখ হাসিনা দল এবং সরকারকে আলাদা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে তিনি গত দুইটি কাউন্সিলে ক্রমশ যারা মন্ত্রী এবং সরকারে আছেন তাদেরকে দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়েছেন।
সর্বশেষ দলীয় কাউন্সিলে এটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ছাড়া মাত্র ৪জন দল এবং সরকারে ছিলেন। এরা হলেন ওবায়দুল কাদের, দলের সাধারণ সম্পাদক। প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি এবং যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। তবে তারা দলের নেতৃত্বে থাকলেও করোনা সংকটের সময় দেখা যাচ্ছে দল পরিচালনার জন্য একটি ভিন্ন ধারা তৈরী করা হয়েছে।
আর এই সময় অসুস্থতার কারণে দলের সাধারণ সম্পাদক ঘরবন্দি রয়েছেন। তিনি ঘর থেকে বিবৃতি দিচ্ছেন। সারাদেশের তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ, সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনা করা এবং সারাদেশের সংগঠনকে চাঙ্গা রাখার দায়িত্বে ক্রমশ সরকারের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দকে সচল এবং সক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তাদেরকেই আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা রকম নির্দেশনা, পরামর্শ দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, মন্ত্রিসভার সদস্য ও সাংসদদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর, যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসনের সাংসদ রণজিত কুমার রায়, নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ শহীদুজ্জামান সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের সাংসদ এবাদুল করিম, জামালপুর-২ আসনের সাংসদ ফরিদুল হক খান, চট্টগ্রাম-১৬ আসনের সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের মধ্যে নওগাঁর শহীদুজ্জামান সরকার ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন। সোমবার ভোর ৩ টায় মারা গেলেন সিলেট সিটির সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন কামরান। এর আগে গত রোববার মারা গেলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সাংসদ মোহাম্মাদ নাসিম এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। এর আগে করোনায় মারা গেছেন সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির, সংরক্ষিত মহিলা (বগুড়া-জয়পুরহাট) আসনের সাবেক সাংসদ কামরুন্নাহার ও সাবেক সাংসদ হাজি মকবুল হোসেন।
এখন পর্যন্ত সরকারের তিনজন মন্ত্রী ও সাত সাংসদ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মারা গেছেন এক মন্ত্রী ও এক সাংসদ। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে মারা গেছেন সাবেক সচিব এম বজলুল করিম, অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়া অতিরিক্ত সচিব তৌফিকুল আলম, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের পরিচালক মো. ফখরুল কবির, উপকর কমিশনার সুধাংশু কুমার, রাজস্ব কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা উৎপল হাসান, দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান প্রমুখ।
গত শনিবার দিবাগত রাতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নতুন সচিব আবদুল মান্নানের স্ত্রী কামরুন নাহার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। করোনায় মারা গেছেন সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী বেগম সাহান আরা আবদুল্লাহ। শিক্ষাবিদদের মধ্যে মারা গেছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুরসহ কয়েকজন। এ ছাড়া করোনার কাছে হার মেনেছেন ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য নাজমুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাকিল উদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া পানি বিশেষজ্ঞ এম এ সামাদ, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম, পপুলার গ্রুপের চেয়ারম্যান তাহেরা আক্তার, নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী খোকন সাহা, ব্র্যাকের পরিচালক আফতাব উদ্দীন আহমদ, সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা মো. ইমামুল কবীর প্রমুখ মারা গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম ব্যবস্থাপক আশরাফ আলী, রূপালী ব্যাংকের উপ মহাব্যবস্থাপক সহিদুল ইসলাম খান, সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার মাহবুব এলাহী, সিটি ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের মুজতবা শাহরিয়ার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদসহ বেশ কয়েকজন ব্যাংকার মারা গেছেন। করোনাকালীন এই সঙ্কটসময়ে আওয়ামী লীগকে এখন বিশেষ কৌশলেই সামনে এগুতে হবে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।


বিজ্ঞাপন