কর্মসঙ্কটে ঢাকা ছাড়ছে অনেকে

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় লন্ডভন্ড পুরো বিশ্ব। চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল এরপর এবার বাংলাদেশও তার আসল রুপ দেখাতে শুরু করেছে করোনা। প্রতিদিন হু হু বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। লাশের সারিতে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম।
করোনার প্রভাব সাধারণ মানুষের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। করোনার প্রভাবে অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। আবার অনেকের মধ্যেই চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন গার্মেন্ট এর অর্ডার বাতিল হওয়ায় তারাও হাটছে কর্মী ছাটাই এর দিকে। ইতোমধ্যে অনেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী ছাটাই কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে সাধারণ কর্মীদের ওপর। আর রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন। এরপর কর্ম হারানো মানুষ পড়েছে বেশি বিপাকে। তাদের মধ্যে অনেকেই বাসা ভাড়ার কথা চিন্তা করে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
কর্ম হারানো এমন একজনের সঙ্গে কথা হয়। নাম আব্দুর রহিম। রহিম ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় পরিবারসহ বসবাস করতেন। তিনি বলেন গত ১২ বছরের মধ্যে এমন কঠিন সময় কখনো পার করিনি। গার্মেন্টসে কাজ ভালোই চলছিল। করোনার কারণে গত মাসে গার্মেন্টস থেকে ফুল বেতন পাইনি আর এর মধ্যে চাকরি হারালাম। এ অবস্থায় আর ঢাকা থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছি।
ঢাকা ঘুরে দেখা যায়, কর্ম দিবসের ব্যস্ত ঢাকার চিত্র সন্ধ্যার আগেই পুরোপুরি পাল্টে যায়। থমথমে পরিবেশ তৈরি হয় নগরীর সিংহভাগ এলাকায়। সরকারি বা বেসরকারি সব অফিসই নির্ধারিত সময়ের আগেই খালি হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন মানুষ চলে যান যে যার বাসায়। এর আগে করোনা হুমকিতে বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন সংক্ষিপ্ত করা হয়। ওইদিন থেকেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। তবে তার আগেই শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ রাজধানী ছাড়ে। অভিভাবকদের অনেকেই তাদের সঙ্গী হয়। এতে নগরীর জনসংখ্যাও কমতে থাকে। করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগের মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়া এবং জনসমাগম স্থানগুলো এড়িয়ে চলার সরকারের নির্দেশনাও ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
পেশাগত কাজের চাপ না থাকলে রাজধানীর বাসিন্দারা শপিংমল, মার্কেট, ফুডকোর্ট, রেস্টুরেন্ট বা বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ভিড় জমায়। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাণের ঝুঁকি যেখানে, মন টানে না বিনোদনে। গত কয়েকদিন ধরে তাই খা খা করছে কেনাকাটার ভিড় লেগে থাকা শপিংমলগুলো। ক্রেতা না পাওয়ায় শপিং মলের অনেক দোকানই বন্ধ রাখা হচ্ছে। তবে ভিড় বেড়েছে কাঁচা বাজারে আর পাড়ার মোড়ের মুদি দোকানে। বিপর্যয় আসন্ন ধরে নিয়ে এক শ্রেণির মানুষ নিত্যপণ্য কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ক্রেতা ও বিক্রেতাকে নির্ধারিত দামে পণ্য বেচাকেনা করতে বলা হচ্ছে বার বার। বলা হচ্ছে, দেশে প্রচুর পরিমাণে পণ্য মজুদ রয়েছে।
সকালে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল গিয়ে দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাসের জন্য অনেক যাত্রী অপেক্ষা করছেন। আলাপকালে একজন যাত্রী জানান, ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ। সে কারণে স্ত্রীসহ ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। গাবতলী বাস টার্মিনালের একজন বাস মালিক বলেন, গত দুই তিন দিন ধরেই দূরপাল্লার বাসগুলোতে ভিড় লেগেই আছে। পরিবার পরিজনকে মানুষ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, করোনার ঝুঁকি এড়াতেই মানুষ ঢাকা ছাড়ছে।
এদিকে, ঢাকায় চলাচলরত সিটি সার্ভিসের বাসগুলোতে যাত্রী সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। বাস চালকরা জানান, কোনো স্টপেজ থেকেই পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে মালিকরা বাসের ট্রিপ কমিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা জানান, গত কয়েক দিন ধরেই বাসগুলোতে যাত্রী সংখ্যা কমে গেছে। করোনা সংক্রমণের প্রস্তুতি না থাকার কারণেও অনেক যাত্রী গণপরিবহন এড়িয়ে চলছেন বলে জানান তিনি।
মহামারী করোনা পরিস্থিতিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, বেশিরভাগ বাড়িতেই দু-একটা ফ্ল্যাট ফাঁকা আছে। ভাড়াটিয়া চেয়ে ‘টু লেট’ লেখা বিজ্ঞাপন সাঁটানো থাকলেও বাড়ির মালিকরা ভাড়াটিয়া খুঁজে পাচ্ছেন না। মুলত, বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের স্বপ্ন গড়ার শহর ছিল ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই নগরে মানুষ বাড়ছিল জ্যামিতিক হারে। কিন্তু গত মার্চে দেশে করোনাভাইরাস হানা দেয়ার পর সেই মানুষদের স্বপ্ন যেন ভাঙতে শুরু করেছে।
তবে গত ক’মাসে আয় রোজগার কমে এমনকি কর্ম হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষ। হতদরিদ্ররা হয়ে পড়েছে আরও অসহায়। জীবিকার এমন সংকট দেখা দেয়ায় ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। তাতে রাজধানীর অনেক বাড়িতে ভাড়াটিয়া সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য এখন বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে বাসাভাড়া দেয়ার বিজ্ঞাপন ‘টু লেট’।
জানা গেছে, দেশের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কাজের সন্ধানে রাজধানীমুখী হতেন। প্রতিদিনই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় আসত মানুষ। এভাবে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় প্রায় দুই কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা। এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর বাসার উচ্চ ভাড়া দিয়ে আসছেন।
কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসা ভাড়ার চিত্রও। করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, ফলে আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা, ফলে ছেড়ে দিচ্ছেন বাসা, ছেড়ে দিচ্ছেন ঢাকাও। দু-একটি ফ্ল্যাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ার মধ্যেই বাড়ির মালিককে বাসা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছেন আরও অনেক ভাড়াটিয়া। বেশিরভাগ বাড়িতে ‘টু লেট’ বিজ্ঞাপনের হেতু জানতে রাজধানীর বেশ কিছু বাড়ি মালিকের সঙ্গে কথা হয়।
তারা জানান, সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের কারণে অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। পরিবারের উপার্জনের ব্যক্তিটি পরে বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো মেস বা ছোট বাসায় উঠেছেন, যে কারণে অনেক বাসা ফাঁকা হয়ে গেছে। এছাড়া এই পরিস্থিতিতে নতুন কেউ বাসা পরিবর্তন করেননি এবং জীবিকার তাগিদে ঢাকায় নতুন মানুষও তেমন একটা আসেননি। যে কারণে বাসাগুলো ফাঁকা রয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে ঠিক মত বেতন না পাওয়া, কাজ না থাকা, এমনকি চাকরি হারানোই বড় কারণ।
এ বিষয়ে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার একটি বাড়ির মালিক জয়নাল হক বলেন, আমার পাঁচতলা বাড়ির দুটি ফ্ল্যাট গত দুই মাস ধরে ফাঁকা। আগে ‘টু লেট’ সাঁটানোর সাতদিনের মধ্যে বাসা ভাড়া হয়ে যেত। কিন্তু এখন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না। আশপাশে আরও কিছু বাড়িতে এভাবে ‘টু লেট’ বিজ্ঞাপন ঝুলছিল। তিনি বলেন, ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে অনেকেই গ্রামে চলে গেছেন। অনেকে পরিবারকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে কোনো মেসে উঠেছেন। অনেকের ইনকাম কমে গেছে, যে কারণে আগে ১৬ হাজার টাকার বাড়িতে থাকলেও এখন ১০ হাজার টাকা ভাড়ার বাসায় চলে যেতে চাচ্ছেন। অনেকে চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তেমন ব্যবসা না হওয়ায় পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। অনেকের ইনকাম না থাকায় দুই মাস ধরে বাসা ভাড়া দিতে পারেননি। যে কারণে বাড়ির মালিক রাগে তাদের বের হয়ে যেতে বলে ‘টু লেট’ টাঙিয়েছেন। সব মিলিয়ে এখন রাজধানীর অনেক বাড়িতেই দু-একটি ফ্ল্যাট ফাঁকা রয়েছে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, অনেকেরই আয় কমেছে। এই অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করা অনেকেরই জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা হলেও বাড়ি ভাড়া মওকুফ করার জন্য, কিন্তু আমাদের কথা কেউ শুনছেন না। অনেক মানুষ বেকার এবং আয় কমে যাওয়ার কারণে তাদের পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর আয়ের আশায় তিনি নিজে কোনো একটি মেসে বা কম টাকা ভাড়ার বাসায় উঠেছেন।
এদিকে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ। অন্য এক জরিপে দেখা যায়, ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসার ভাড়ায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরের পর বছর বাড়ি ভাড়া যে বেপরোয়াভাবে বেড়েছে, তাতে আয়-ব্যয়ে প্রকট অসামঞ্জস্যতা নিয়ে থাকতে হয়েছে লোকজনকে। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ায় নিরুপায় হয়ে মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন, তাতে তৈরি হচ্ছে ভাড়াটিয়া সংকট। এই সংকট সামনের দিনগুলোতে আরও প্রকট হতে পারে।


বিজ্ঞাপন