ঢাকার খালগুলো শুধু কাগজে-কলমে বাস্তবে অস্তিত্বহীন

জাতীয় রাজধানী

বিশেষ প্রতিবেদক : শুধু বেড়িবাঁধের কারণেই নয় ঢাকা সিটির পানি বের হওয়ার জন্য যেসব খাল ছিল সেগুলো অস্তিত্বহীন। যে কয়টা খালের সামান্য অস্তিত্ব আছে সেগুলোও দখলে দূষণে মৃত প্রায়। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এখন বেহাল অবস্থা। ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার করেও কোনো লাভ হয় না। পরিবেশ দূষণের প্রধান বস্তু পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানী সড়কগুলো পানিতে থৈ থৈ করে।
ঢাকার ভেতরের খালগুলোও দখলমুক্ত ও সংস্কার করা হয়নি। গত কয়েক বছর যাবত উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়িতে রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থার বেহাল দশা। এতে সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে রাজপথ থেকে অলি-গলি সব তলিয়ে যায়। এছাড়া ঢাকার চারপাশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধেরও চরম দুরবস্থা। বিশেষ করে ঢাকার পূর্বাঞ্চলে কোনো বাঁধই হয়নি। ফলে পূর্বাঞ্চল একেবারেই অরক্ষিত।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, গত মে মাসে দেশে গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৭ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুন-জুলাই-আগস্টেও অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা। তাছাড়া পরপর এই তিন মাসেই বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী নিম্নচাপের আভাস রয়েছে। এরফলে দেশে অধিক বৃষ্টিপাত হবে। এমনিতে সমান্য বৃষ্টি হলে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জমে হাঁটু পানি। অলি-গলি সবখানে পানি থৈ থৈ করে। এ অবস্থায় টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলে পানিবদ্ধতার পাশাপাশি আশপাশের নদীর পানি ঢুকে রাজধানী তলিয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারি দুর্যোগের ভেতরেই বন্যাকবলিত হতে পারে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। আর দেশের মধ্যাঞ্চল বন্যাকবলিত হলে তলিয়ে যাবে রাজধানী ঢাকা।
পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, বর্ষাকালে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু এসব নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। নদীগুলো দখল ও ভরাট হওয়ার কারণে সামান্য পানি বৃদ্ধি হলেই বন্যায় রূপ নেয়। এ ক্ষেত্রে শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ বন্যার কবল থেকে রাজধানীকে রক্ষা করে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এ বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয় না। ঢাকার পূর্বাঞ্চলে কোনো বাঁধই নির্মাণ হয়নি।
জানা গেছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজধানী ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চল শহর রক্ষা বাঁধের এখন বেহাল দশা। সংস্কারের অভাবে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলের বাঁধের ১৪ কিলোমিটারজুড়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে মাটি ধসে গেছে। ফলে এই বাঁধ রয়েছে ঝুঁকির মুখে। অন্যদিকে, রাজধানীর পূর্বাঞ্চল একেবারেই অরক্ষিত। ‘ঢাকা পূর্বাঞ্চলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও বাইপাস’ প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এবং শীতলক্ষ্যার পানি বৃদ্ধি হলে যেকোনো সময় রাজধানী ঢাকা খুব সহজেই বন্যাকবলিত হয়ে পড়বে বলে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন।
ঢাকার অনেকগুলো খাল যেমন দখলে দূষণে বিলীন হয়ে পড়েছে তেমনি এর চার পাশের নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা এগুলো নিষ্প্রাণ। দখলে দূষণে এগুলো প্রবাহহীন। এ ছাড়া দখলের ফলে বালুনদী এখন প্রায় মৃত। এ সব নদী দিয়ে ঢাকার পানি প্রবাহিত হয়। এসব নদীর প্রবাহ না থাকায় রাজধানীর পানি সহজে বের হতে পারে না।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন দুই কোটি পলিথিন জমছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিনকে ঢাকার পানিবদ্ধতার জন্যও দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছে পবা। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পবার সদস্য মো. আবদুস সোবহান বলেন, সারা দেশে প্রায় ১২০০ কারখানায় নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয় যেগুলো পলিথিন বর্জ্য। এ বর্জ্য সামান্য বৃষ্টিতে নগরে পানিবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া এসব পলিথিন ঢাকার চারপাশের নদীগুলো তলদেশও ভরাট করছে। তিনি বলেন, পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর ২০০২ সালে নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও পরিবেশ অধিদফতরের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ সেই আইন কার্যকর হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫৮টি খাল চিহ্নিত করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে ৩৭টি খালের অংশ বিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। ফলে খালগুলোর প্রবাহ আর স্বাভাবিক নেই। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২২টি খালের মধ্যে একমাত্র ধোলাইখালের একটা অংশ (সূত্রাপুর লোহারপুল থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত) ও মেরাদিয়া খাল সচল আছে। বাকি সব ক’টি খালের জায়গায় এখন রাস্তা। প্রতিবেদনে এমনটা বলা হলেও নন্দীপাড়া খাল এখনো সচল আছে। প্রবাহ আছে কুতুবখালী খালেও। যে খালগুলো এখনো টিকে আছে সেগুলোর অধিকাংশ ময়লা-আবর্জনার চাপে স্বাভাবিক প্রবাহ ধরে রাখতে পারছে না। দখল আর ভয়াবহ দূষণের ফলে ঢাকার পানি প্রবাহ মারাত্মক ব্যাহত হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই ঢাকার রাস্তায় হাঁটু পানি জমে যায়।


বিজ্ঞাপন