নকল মাস্ক-মানহীন সুরক্ষা পণ্যে বাজার সয়লাব

অপরাধ স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার মাছ ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল হোসেন। করোনা ভাইরাসের কারণে তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার চালানোর জন্য এখন তিনি মাস্কের ব্যবসা করেন। একটি অভিজাত শপিংমলের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী শাকিলেরও একই অবস্থা। দোকান বন্ধ থাকায় তিনি চীন থেকে এন-৯৫ মাস্ক এনে বিক্রি করছেন।
ইসমাইল পুরান ঢাকা থেকে এন-৯৫ মাস্ক পাইকারী কিনলেও শাকিল চীন থেকেই পণ্য আনেন। কথা বলে জানা গেলো, তাদের কারোরই এসব পণ্যের ব্যবসার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। অনুমোদন নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ব্যবসা। আর চাহিদা বেড়েছে মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রীর। জীবন বাঁচাতে মানুষ আসল-নকল যাচাই করেই কেনার চেষ্টা করলেও বাজারের এত বেশি নকল পণ্য সরবরাহ হয়েছে যে নকলটাই আসল ভেবে কিনছেন ক্রেতারা। নকল ও ভেজাল সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চললেও থেমে নেই এসব পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়।
শাকিল বলেন, আসল নকল আমি চিনি না। হ্যান্ডসেট বিক্রি বন্ধ, তাই কিছু করে সংসার চলছে। ইসমাইল, শাকিলদের মত ব্যবসায়ীরা নকল (কপি) কেএন-৯৫, এন-৯৫ মাস্ক বিক্রি করায় চরম হুমকির মুখে পড়ছে জন-জীবন। নকল মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির অপরাধে ২২ জুন ঢাকার মোস্তফা কামাল নামের এক খুচরা ব্যবসায়ীকে এক বছর কারাদ- দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এর আগে ১০ জুন র‌্যাবের ভ্রাম্যমান আদালত নিউমার্কেটের ৪টি দোকানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছে। রাজধানীর পান্থপথে এএসএম ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ নকল গ্লাভস ও গাউন জব্দ করেছে র‌্যাব। এ সময় ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও গোডাউন সিলগালা করা হয়।
বাংলামটরের জহুরা টাওয়ার থেকে অ্যাডভান্স বায়ো কেমিক্যাল (এবিসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান এন-৯৫ বলে নকল মাস্ক কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছিল। এছাড়া সেখানে এন-৯৫ ছাপ দেওয়া অনেক মাস্কের খালি প্যাকেটও পাওয়া গেছে। নকল মাস্কগুলো এসব ব্যাগে ভরে বিক্রি করতো। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে চীন থেকে নি¤œমানের মাস্ক এনে এন-৯৫ বলে বিক্রি করে বলে আইনশৃংখলা বাহিনীকে জানিয়েছে। প্রত্যেকটি পণ্য ১০-১৫ গুণ দামে তারা বিক্রি করত। পণ্য আমদানির কোন বৈধ কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ক্রয় বিভাগের সহকারী পরিচালক মেজবাউর রহমান বলেন, আমরা চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করছি। বাজারে কিভাবে নকল মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে আমার জানা নেই।
এদিকে নকল মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রী বাজারে ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত আমদানিকারকরা। তারা বলেন, কোন মেডিকেল পণ্য আমদানি করতে হলে প্রথমেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সিই সার্টিফিকেট, এফডিএ সার্টিফিকেট, আইএসও সনদ, আমদানিকারক যার কাছ থেকে পণ্য কিনেছেন সেই রপ্তানিকারককে বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে কিনা সেই অথরাইজেশনসহ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আমদানির অনুমতি পত্রের জন্য আবেদন করতে হয়। এসব কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে অনুমোদন পেলে এলসি করার পরে চীন থেকে পণ্য দেশে আসতে প্রায় একমাস চলে যায়।
শাকিল ও ইসমাইলের মত কারও নেই আমদানির সার্টিফিকেট, এমনকি তারা জানেন না কিভাবে এলসি দিতে হয় কিংবা এই জরুরি সামগ্রীগুলো আমদানি করতে সরকারের কোন দপ্তরের অনুমোদন নিতে হয়। তারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠিয়ে প্রতিযোগীতার মাধ্যমে কমদামের পণ্য কিনে এয়ারপোর্টের অসাধু সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীদের ওয়্যার হাউজে দিয়ে দেন। এক সপ্তাহ থেকে ১০দিন পর ঢাকায় নিজেদের গোডাউনে রেখে অধিক দামে বিক্রি করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মধ্যে চৌধুরী সফিউল আজম রাসেলের মালিকানাধীন চৌধুরী ট্রেডাস সার্জিক্যাল মাস্ক আমদানীর অনুমোদন নিলেও এনেছেন নকল এন-৯৫ মাস্ক। আশা এন্টারপ্রাইজের নামে ডোর টু ডোর বিক্রি করে দিয়েছেন এসব নকল মাস্ক।
এ বিষয়ে জানার জন্য চৌধুরী সফিউল আজম রাসেলের মোবাইল ফোনে একাধিক বার কল ও ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এ বিষয়ে রুমঝুম ইন্টারন্যাশনালের মালিক সাইফুর রহমান সাইফ বলেন, দেশে ৫০-৬০ টাকায় নকল এমসিকন মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। কোনভাবেই বৈধ চ্যানেলে মাল এনে এত কাম দামে মাস্ক বিক্রি করা সম্ভব নয়। তাই আর মাস্ক আমদানি করবো না। মাস্ক, মোবাইল আর অক্সোমিটার থারমোমিটারের ব্যবসা এক নয়। করোনার এই মহামারিতে মানুষের জীবন রক্ষায়, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিদপ্তরের সহায়তা কামনা করছি। ঢাকা কাষ্টমস হাউজের কর্মকর্তারা কিভাবে এসব নকল পণ্য ছাড় করে সেটিও সংশ্লিষ্টদের জানা উচিত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই বিদেশ থেকে মানহীন পণ্য এনে অভিজাত ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করছে। এসব নকল পণ্যই বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ভেজাল ও নকল বিরোধী অভিযান চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।


বিজ্ঞাপন