করোনায় উপেক্ষিত ডেঙ্গু

জাতীয় ঢাকা রাজধানী স্বাস্থ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২০১৯ সালে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত বিষয় ছিল ডেঙ্গু। গত বছরই ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করে বাংলাদেশ। এতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন লক্ষাধিক মানুষ এবং মারা যায় প্রায় ২০০ জন। এদিকে গত বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হলেও চতুর্থ মাস থেকে ধীরে ধীরে সেটি কমে এসেছে। আর এখন চলছে করোনা মহামারির প্রকোপ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার প্রকোপের কারণে ডেঙ্গু হয়তো চাপা পড়ে যাচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে রয়েছে, জ্বর হলে বাসায় থাকছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। হয় কোভিড নয়তো নন-কোভিড হিসেবে তাদের চিকিৎসা চলছে। উপেক্ষিত থাকছে ডেঙ্গু।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ ২৮ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২২ জন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৩১৮ জন।
এছাড়া চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব থেকে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন এবং জুন মাসে ১৬ জন।
গত বছরের হিসাব থেকে দেখা যায়, জানুয়ারিতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন, এপ্রিলে ৫৮ জন, মে মাসে ১৯৩ জন এবং জুন মাসে এক হাজার ৮৮৪ জন।
গত ৯ মে করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করার নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে ৬৪ জেলার সিভিল সার্জন ও উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা।
নাসিমা সুলতানা বলেন, এই আলোচনা সভায় ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেহেতু করোনা এবং ডেঙ্গু রোগী উভয়ের জ্বর থাকে, সে কারণে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পাশাপাশি সন্দেহভাজন রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করার অনুরোধ করা হয়েছে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু কিট সরবরাহ করেছে।
এদিকে এডিস মশার ডেনসিটি (ঘনত্ব) খুবই হাই মন্তব্য করে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, সরকারি তথ্যমতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কম। মানুষ এক ধরনের আতঙ্কে রয়েছে। জ্বর হলেই বাসায় থাকছে, হাসপাতালে যাচ্ছে না, কারণ সেখানে গেলেই তাকে করোনা ইউনিটে ভর্তি করিয়ে দিতে পারে। হাসপাতালে কেউ গেলেও সেখানে মূল ফোকাস থাকে করোনা। করোনা নেগেটিভ হলে সাধারণ জ্বর হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু পরীক্ষাও হচ্ছে কম; মানুষ যেহেতু এখন ঘরে থাকছে বেশি, তাদের মুভমেন্ট কম, আর মুভমেন্ট কম হলে ভাইরাল ট্রান্সমিশন কম হয়। মূলত এ তিন কারণে এবারে ‘রেকর্ডেড ডেঙ্গু’ রোগী কম পাওয়া যাচ্ছে এডিসের ঘনত্ব বেশি হলেও। যে পরিমাণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী রিপোর্টেড হচ্ছে, বাস্তবে ডেঙ্গু রোগী তার চাইতে বেশি রয়েছে। যদিও সেটা গতবছরের তুলনায় বেশি নয়।
নিয়মিত জরিপের অংশ হিসেবে নতুন এবং পুরান ঢাকা মিলিয়ে গাবতলী বাস টার্মিনাল, উত্তরা, গুলশান, শ্যামলী রিং রোড থেকে শুরু করে ধানমন্ডি, পরীবাগ ও শাঁখারীবাজারে কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, সীমিত পরিসরে এ জায়গাগুলোতে কাজ করা হচ্ছে পরিস্থিতি বোঝার জন্য। জুন মাসে প্রতিটি জায়াগায় এডিসের ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর ওপরে পাওয়া গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, অন্য জায়গাতেও এই অবস্থা কাছাকাছিই হবে।
তিনি বলেন, মশা পরিমাপের সূচক ব্রুটো ইনডেক্স নামে পরিচিত। আর ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি হলে তাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়, এরকম হলে এডিস ট্রান্সমিটেড ডিজিজ হবে বলেই আমরা ধরে নেই।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি ডা. মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যদি গতবারের মতো হয় তাহলে কিন্তু মারাত্মক পরিণতি হবে। সেদিকে নজর রেখেই সবাইকে সক্রিয় থাকা দরকার এডিসের উৎস্য নিধনে। করোনা শনাক্তকরণে যে পরীক্ষা হচ্ছে তার মধ্যে যারা করোনায় আক্রান্ত না তাদের কী সমস্যা ছিল সেটা আর পরীক্ষা বা মনিটরিং হচ্ছে না। তাদের মধ্যে কারো ডেঙ্গু ছিল বা আছে কি না সেটাও দেখা হচ্ছে না, যা বিপজ্জনক।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল (ডা.) মো. শরীফ আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু নিধনে সব ধরণের কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন স্থানে মশক নিধন কার্যক্রম শুরু করেছি এবং সকল স্থানে ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত মশার লার্ভা ধ্বংসকারী ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এবার আমরা যে কার্যক্রমগুলো হাতে নিয়েছি তা ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করবে বলে আশা করি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ত থাকায় কোন মন্তব্য করতে চাননি।


বিজ্ঞাপন