সিলিন্ডারের কৃত্রিম সংকট

অপরাধ স্বাস্থ্য

৬৫০০ টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ২২০০০ টাকা

 

আব্দুল লতিফ রানা : মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস বাংলাদেশে প্রথম গত ৮ মার্চ সনাক্তের পর ১৭ মার্চ আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজন মারা যান। করোনা সংক্রমনের শুরুর দিকে আক্রান্তের সংখ্যা কম থাকলেও এখন অস্বাভাবিক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
আর এ কারণে সারাদেশেই আক্রান্ত রোগিদের জন্য অক্সিজেন ডিলিন্ডারের ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই সুযোগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিকভাবে সিলিন্ডারের অক্সিজেনের দাম বৃদ্ধি করেছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি বাজার থেকে এই অক্সিজেন সিলিন্ডারও উধাও হয়ে গেছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার সার্জিক্যাল ব্যবসায়ী মেসার্স হেলথওয়ের স্বত্বাধিকারী নূর হোসেন জানিয়েছেন, কয়েক মাস আগেও একটি সিল্ডিার গ্যাসের মূল্য ছিল ছয় হাজার থেকে ছয় হাজার ৫০০ টাকা। যা বর্তমানে ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগেও তিনি প্রতিটি সিলিন্ডার ১২ হাজার টাকায় কিনেছিলেন।
জানা গেছে, দেশের বাজারগুলোতে অক্সিজেন সিলিন্ডার, রেগুলেটর কিংবা ফ্লু মিটারের কোনো অভাব নেই। কিন্তু এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ওই চক্রটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অস্বাভাবিক দামে বিক্রি করছেন। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে ভুক্তভোগিরা মনে করছেন। তারা বলছেন, প্রতিদিনই চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সিলিন্ডার, রেগুলেটর ও অন্যান্য সামগ্রী দেশে আসছে। আর এগুলোর সংকট হওয়ার কোনো কারণই নেই। তার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরী করে দাম বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি কেরানীগঞ্জের কালিন্দী এলাকার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন রাজধানীর মগবাজার এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে যান। সেখানে সিলিন্ডারের মূল্য কত জানতে চাইলে দোকানী প্রথমে তার সঙ্গে কথা বলতেই রাজী হননি। এরপর তিনি একজন সার্জিক্যাল পণ্য আমদানিকারক হিসেবে পরিচয় দেন। তার ওই পরিচয় জানার পর মগবাজারের ওই অসাধু ব্যবসায়ী তার সঙ্গে কথা বলেন। এসময় প্রতিটি সিলিন্ডার অক্সিজেনের মূল্য তার কাছে ২২ হাজার টাকা চাওয়া হয়। অথচ তিনি এক মাস আগেও মাত্র ১২ টাকায় টাকায় কিনেছিলেন।
আর হোসেল নামের একজন সিলিন্ডার অক্সিজেন বাসায় সরবরাহকারী জানান, গত কয়েকদিন ধরে কোনো সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন দামের প্রশ্ন না। দাম যা চাওয়া হচ্ছে, সে মূল্যেই লোকজন তাই দিয়েই কিনছেন। কিন্তু সিলিন্ডার না থাকায় সরবরাহ দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। সরবরাহ দিতে পেতে হলে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে জানান সোহেল।
অক্সিজনের মূল্য ও সরবরাহ সম্পর্কে জানতে চাইলে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্প্রেক্টার কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, দেশে অক্সিজেনের অভাব নেই। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা বাড়ায় ফ্লু মিটার ও সিলিন্ডারের ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। প্রতি কিউবিক লিটার অক্সিজনের মূল্য ৬৫ টাকা। পরীক্ষিিত একটি সিলিন্ডারে অক্সিজন ভরে দেওয়া হলে সেটির মূল্য পড়ছে পরীক্ষা ফি ও রিফিলসহ ১৭৩ টাকায়। কিন্তু সিলিন্ডার ও ফ্লু মিটার সংকট তা বাইরে অস্বাভাবিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। আর এক হাজার ৬০০ টাকার আরগন গ্যাস এখন ২০ হাজার টাকায়ও সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, সিলিন্ডারের সংকট রয়েছে কীনা? তা জানা নেই, তবে বাজারে অক্সিজন সিলিন্ডারের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। এ অবস্থায় যেসব সিলিন্ডার অব্যবহৃত রয়েছে তা ব্যবহার করতে হবে বলে জানান তিনি।
শুধু সিলিন্ডার অক্সিজেনই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীরা নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতদিন সিলিন্ডারের অক্সিজেনের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বর্তমানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সীমিত সংখ্যক সিলিন্ডার দিয়ে সব রোগীকে পর্যাপ্ত ও নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছেনা।এই অবস্থায় দেশের সব হাসপাতালগুলোতে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের জন্য চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগী সাধারণ ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু অবশিষ্ট ১০ শতাংশ রোগীদের মধ্যে অনেকের হালকা থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়। এ সময় রোগীদের অক্সিজেনের লেবেল কমে যায়। তাই এ ধরনের রোগীদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করাই হলো মূল চিকিৎসা। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত হেলথ বুলেটিন অনুসারে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত রাজধানীসহ সারাদেশে ভাইরাসে ১ হাজার ৯৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পেয়ে রোগীর মৃত্যু হয়েছে-এমন অভিযোগও রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৩৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, বিশেষায়িত এবং ২৫০ শয্যার হাসপাতালে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের জন্য এক চিঠির মাধ্যমে নির্দেশ দেন।
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য নির্মিত চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক নির্মিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন সিস্টেম থাকলেও অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন না থাকায় রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এমতাবস্থায় করোনা রোগীদের নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের নিমিত্তে যেসব হাসপাতালে অক্সিজেন ট্যাংক এখনও স্থাপন করা হয়নি, সেসব হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংক স্থাপনের (প্রয়োজনে গ্যাস সিস্টেম লাইন সম্প্রসারণ) জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সূত্র জানায়, ৩৯টি হাসপাতালের মধ্যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে ১৮টি। এগুলো হলো-ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বগুড়া, এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দিনাজপুর, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল টাঙ্গাইল, এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সিলেট, শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গাজীপুর, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মৈত্রী হাসপাতাল ঢাকা।
এছাড়া, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেলা হাসপাতালের সংখ্যা রয়েছে ১৬টি। সেগুলো হচ্ছে, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল ঢাকা, কক্সবাজার জেলা হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, মুন্সিগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, জামালপুর জেলা হাসপাতাল, হবিগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, শেরপুর জেলা হাসপাতাল, চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, সুনামগঞ্জ জেলা হাসপাতাল, নীলফামারী জেলা হাসপাতাল, বাগেরহাট জেলা হাসপাতাল, বরগুনা জেলা হাসপাতাল, চুয়াডাঙ্গা জেলা হাসপাতাল, ভোলা জেলা হাসপাতাল এবং মাগুরা জেলা হাসপাতাল।
এছাড়া, দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা পাঁচটি। সেই পাঁচটি হাসপাতার হচ্ছে, শেখ আবু নাসের স্পেশালাইজড হাসপাতাল খুলনা, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ঢাকা এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল ঢাকা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল ঢাকা, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান ঢাকা।


বিজ্ঞাপন