রমরমা ভেজাল ওষুধের ব্যবসা

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ স্বাস্থ্য

বিশেষ প্রতিবেদক : ঠেকানো যাচ্ছে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরী। রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ি, কামরাঙ্গীরচার, কেরানীগঞ্জ, সাভারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব ভেজালকারীরা ব্যাঙের ছাতামত গড়ে তুলেছেন ওষুধ তৈরীর কারখানা। কারখানাগুলোতে তৈরিকৃত যৌন উত্তেজকসহ বিভিন্ন ওষুধের মোড়ক পরিবর্তন করে আমেরিকার বিখ্যাত ব্র্যান্ড ওষুধ করা হচ্ছে। এরপর তা রাজধানীর মিটফোর্ড, শাহবাগস্থ ওষুধের মার্কেটসহ নামি-দামি বিভিন্ন ফার্মেসিতে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লার মুদি দোকানেও এসব ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। রাজধানীর উত্তরায় এমন একটি নকল ওষুধ তৈরির কারখানায় ওষুধ প্রশাসন ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আটক করা হয়েছে কারখানার মালিকসহ ১৫ জনকে। নকল এসব পণ্য সরবরাহ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উত্তরাস্থ ভেজাল ওষুধ তৈরীর কারখানার মালিকের নাম আবদুস সালাম মল্লিক। তিনি নকল কারখানায় তৈরি নিম্নমানের কাঁচামাল, শিবলী নোমানী নামক এক প্রতারকের হাতে পশ্চিমা দেশগুলোর নামিদামি প্রতিষ্ঠানের ওষুধ সামগ্রী। আর তিনি নিজেই তৈরি করেন নকল মোড়ক। এভাবেই সবার অজান্তে শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন প্রসাধনী পৌঁছানো হয় সাধারণ ক্রেতার হাতে। এসব ওষুধ সর্বনিম্ন ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকায় নিজেদের বিক্রয় কর্মী দিয়ে পৌঁছে দেয়া হয় নামি-দামি ফার্মেসিতে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গত বৃহস্পতিবার উত্তরার বিভিন্ন ফার্মাসিতে অভিযান চালিয়ে এসব নকল ওষুধ উদ্ধার করে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিম্নমানের এসব পণ্য শরীরের ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হতে পারে। আর গোয়ন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, ঔষধ প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে জড়িতরা, ছোটখাটো কয়েকটি বৈধ ওষুধ কাম্পানিও নকল ওষুধ উৎপাদন করে আসছে। নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ হাজার ১৪৫টি মামলা দায়ের করেছিল। এ সময় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। আর জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয় ৩৯ জনকে। তাছাড়া সিলগালা করা হয় ৪৪টি প্রতিষ্ঠান। জব্দ করা হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ। আবার উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় ৪৭ কোটি টাকা মূল্যেও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করা হয়।
এসব পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই এ অপরাধ। নতুন কৌশল অবলম্বন করে নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে অপরাধীরা। তাদেরই অন্যতম একজন কেরানীগঞ্জের রাসেল। এই রাসেল নিজেই কেমিস্ট, নিজেই ফার্মাসিস্ট, আবার ওষুধ কোম্পানির মালিকও। স্কয়ার, বেক্সিমকো, অপসোনিন এবং ইনসেপটার মতো নামিদামি কোম্পানির মোড়ক, বোতল হুবহু নকল করে বছরের পর বছর ধরে অবৈধ এই বাণিজ্যে চালিয়ে আসছেন। রাসেলের মতো ঢাকার মুগদার বাদশা, মিরপুরের সালাউদ্দিন বাবু, পান্থপথের মোহাম্মদ আলী খান, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর এম এ বারেক নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এই অপরাধে তাদের একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছে। এসব নকলবাজরা জেল থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে গেছে পুরোনো ব্যবসায়।
ছোটখাটো কয়েকটি বৈধ কোম্পানিও নকল ওষুধ উৎপাদনে জড়িত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ কারখানায় নকল ওষুধ তৈরি করে তা পাইকারি দোকানে বিক্রি করছে তারা। এসব দোকানের মাধ্যমেই সারাদেশে নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী, বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু ওষুধই নয়, নকল প্রসাধনীর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতার পক্ষে নিম্নমানের এসব ওষুধ চেনা সম্ভব নয়।
মিটফোর্ডে ওষুধের দোকান রয়েছে এমন ১০ থেকে ১৫ জন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, প্রথমে তারা মনে করতেন, বড় কোম্পানির এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারী লট চুরি করে বাজারে বিক্রি করছে। এ কারণে কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, স্কয়ার ফার্মার সিপ্রোসিন নামে এন্টিবায়োটিকের প্রতি পিসের পাইকারি মূল্য সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ টাকা পড়ে, সেখানে তিনি চার থেকে পাঁচ টাকায় তিনি কেনেন। কিছুদিন পর তার ভুল ভেঙে যায়। জানতে পারেন একটি চক্র নামিদামি কোম্পানির নকল ওষুধ উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। এরপর থেকে তারা কোম্পানি কর্মী ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে ওষুধ কেনেন না।
অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতির কয়েক নেতা এবং ঔষধ প্রশাসনের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব অপকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা। পাইকারি মার্কেট ও ছোটখাটো ওষুধ কারখানায় ড্রাগ সুপার বা ঔষধ প্রশাসনের কর্তাদের নিয়মিত তদারকির অভাবে দীর্ঘদিন ধরে ভেজালকারীদের বিশাল সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে। ড্রাগ সুপাররা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ায় তাদের চোখের সামনেই চলছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের নকল আর ভেজালের খেলা। মাঠ পর্যায়ে ড্রাগ সুপারদের অসাধুতার জন্যই ভেজাল সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেও আপোস করতে হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে।
মিটফোর্ডের পাইকারি কয়েকটি মার্কেটে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, সুপরিচিত কোম্পানির নকল ওষুধ এবং অখ্যাত কোম্পানির ওষুধে সয়লাব বাজার। মোড়ক দেখে যা চেনার উপায় নেই। বিশেষ করে জরুরি প্রয়োজনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নকল হচ্ছে বেশি। কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বড় কোম্পানির ওমিপ্রাজল গ্রুপের এক বাক্স ক্যাপসুলের দাম ৪০০ টাকা। অথচ নকল করে ওই ওষুধ পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয় মাত্র ৭২ টাকায়। তবে খুচরা পর্যায়ে ৪শ’ টাকাতেই বিক্রি হয় এসব ওষুধ। জীবন রক্ষাকারী প্রাথমিক স্তরের প্যারসিটামল, ব্যথানাশক ডাইক্লোফেনাক, অ্যান্টিবায়োটিক এজিথ্রেমাইসিন, ফ্লুক্লোসাসিনসহ সব গ্রুপের ওষুধই নকল ও ভেজাল হচ্ছে।
নকল কোম্পানি তাদের ওষুধ সারাদেশে ছোট ছোট ফার্মেসিতে ছড়িয়ে দিতে না পারায় রাজধানীর মিটফোর্ড, মিরপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনার হেরাজ মার্কেট, চট্টগ্রামের হাজারী লেন, কুমিল্লার শাসনগাছা, রাজশাহীর সাহেববাজারের মতো ওষুধের বড় বড় পাইকারি মার্কেটের মাধ্যমে তা সারাদেশে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এর আগে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২৯ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়।
এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রয়েল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ ও স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ, চুয়াডাঙ্গার এজটেক ফার্মাসিউটিক্যালস, দিনাজপুরের বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, গাজীপুর কোনাবাড়ীর ব্রিস্টল ফার্মা, বরিশালের ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, রাজধানীর মিরপুরের ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস, এবলেশন ল্যাবরেটরিজ, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস। আর যাত্রাবাড়ীর ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস, পোস্তগোলার মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস, শ্যামলীর ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও তেজগাঁওয়ের রেমো কেমিক্যালস, নারায়ণগঞ্জের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, সাভারের সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস ও এভার্ট ফার্মা। এছাড়া, কেরানীগঞ্জের ইউনিক ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরাজগঞ্জের ওয়েসিস ল্যাবরেটরিজ ও রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস, পাবনার ইউনিভার্সাল ফার্মাসিউটিক্যালস, সিলেটের জালফা ল্যাবরেটরিজ, নওগাঁর নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, বরিশালের প্যারাডাইস ফার্মা, কুষ্টিয়ার কোয়ালিটি ফার্মাসিউটিক্যালস। আবার ফরিদপুরের বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যালস, ময়মনসিংহের স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেভ ফার্মাসিউটিক্যালসের বিরুদ্ধে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিলের পরও তারা উচ্চ আদালতে রিট করে ওষুধ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। ভেজাল ওষুধ তৈরীর বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবির উত্তর) এর উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেছেন, প্যাকেট, বোতল কিংবা ওষুধের কোনো অংশই বিদেশ থেকে আনা হয় না। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মাসিতে নকল ওষুধ সরবরাহ করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।


বিজ্ঞাপন