চিকিৎসার নামে কিশোরীকে খুন!

অপরাধ এইমাত্র জাতীয় স্বাস্থ্য

রিজেন্ট হাসপাতাল

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : রিজেন্ট হাসপাতালে এসএসসি পাশ পল্লী চিকিৎসক দিয়ে ভুল চিকিৎসা দিয়ে এক কিশোরীকে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় ভুয়া চিকিৎসকসহ ৪জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ পত্র দেওয়া হলেও প্রতারক সাহেদকে আসামি করেনি পুলিশ।
নিহত কিশোরীর নাম জান্নাতুল ফেরদৌস (১৬)। গত ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই ঘটনাটি ঘটেছে প্রতারক সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাপাতালে। হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া এক ভুয়া চিকিৎসকের কারণেই ওই কিশোরী মারা গেছেন বলে পুলিশী তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে।
পুলিশের তদন্তে বলা হয়েছে, এসএসসি পাস একজন ব্যক্তিকে চিকিৎসক হিসেবে রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়োগ দেয়। আর ওই ব্যক্তিকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে দৃশ্যত ওই কিশোরীকে খুন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার তদন্তের পর পুলিশ খুনের অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, রিজেন্ট হাসপাতালের একজন ভুয়া চিকিৎসকসহ ৪ জনের নামে দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালের মাীলক প্রতারক সাহেদ করিমকে অজ্ঞাত কারণে আসামি করা হয়নি বলে ভুক্তভোগিরা অভিযোগ করেছেন।
সূত্র জানায়, মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের ওই ভুয়া চিকিৎসকের নাম ফারুক হোসেন। তিনি আদালতে ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দীতে বলেছেন, ‘১৯৯৫ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর আর পড়ালেখা করেননি। পরে ১৯৯১ সালে পল্লী চিকিৎসকের একটি কোর্স করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে প্রথমে ওষুধের ব্যবসা করেন। এসময় কতিপয় ডাক্তারদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই সব ডাক্তাদের কাজে সহায়তা করতে করতেই চিকিৎসার অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আর ওই পরিচয় এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই গত ২০১৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রিজেন্ট হাসপাতালে যায়। এরপর সেখানে এমডি ও মার্কেটিং এর খলিলুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে আইসিইউ ও ওটির কাজ জানার অভিজ্ঞতার কথা জানায়। একপর্যায়ে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদ সাহেব ডেকে নেয়। আর সাহেদ তাকে ওই হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া ডাক্তার হিসেবে নিয়োগ দেন। তার পর থেকেই সে ‘অন কলে’ চিকিৎসা করে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বেলা তিনটায় রিজেন্ট হাসপাতালে যায়। আর তখন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে জান্নাতুল ফেরদৌস শুয়ে ছিল। হাসপাতালের ডাক্তার নাসির উদ্দিন ওই রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া ইনজেকশন দিতে বলেন। পরে সে তাকে ইনজেকশন দেয়। এরপর রোগীর শরীরে অক্সিজেন কমে গেলে কিছুক্ষণ পরই কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌস মারা যায়।
এ ঘটনায় ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেনকে রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার কথা ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়নি।
এ ঘটনার মামলাটি পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. কবির হোসেন তদন্ত করেছেন। তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন, কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌস খুনের মামলায় রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু ভুয়া চিকিৎসক ফারুকের নিয়োগপত্র পাওয়া গেলে সাহেদকে এই খুনের মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি করা হতো।
ভুক্তভোগিরা জানায়, কিরোশী জান্নাতুল ফেরদৌসের বয়স যখন নয় বছর, তখন আগুনে পড়ে গিয়ে তার বাঁ হাত ভেঙে ফেলে। তখন তাকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করা হয়। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাঁ হাত সামান্য বাঁকা হতে থাকে। কিশোররীর বাবা জয়নাল শেখ বলেছেন,ওই ঘটনার সাত বছর পর তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাঁ হাতে সমস্যা হওয়ায় রিজেন্ট হাসপাতালের কর্মচারী সাইফুলের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাইফুল তাকে জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালে ভালো চিকিৎসক আছে। তার মেয়ের চিকিৎসা রিজেন্ট হাসপাতালেই ভালো হবে। এরপর তাকে ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। পরে ওই হাসপাতালের ভুয়া ডাক্তার ফারুক তার মেয়েকে দুটো ইনজেকশন দেয়। এতে কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌস মারা যায়। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় মামলা করা হয়।
মামলাটি প্রথমে পল্লবী থানা পুলিশ তদন্ত করে। এ ঘটনায় থানার পুলিশ প্রথমেই রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার করে। পরে ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ফারুক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তার জবানবন্দীতেই রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান সাহেদের নাম প্রকাশ পায়। কিন্তু পুলিশ কখনই সাহেদকে আটক বা গ্রেফতার করেনি।
সূত্র জানায়, পল্লবী থানা-পুলিশের হাত থেকে মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)র কাছে যায়। এরপর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌস খুন হন বলে প্রকাশ পায়। গোয়েন্দা পুলিশ রিজেন্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাউল আলম ও রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক নাসির উদ্দিন সিকদারকে মামলা থেকে বাদ দেন। আর ভুয়া চিকিৎসক ফারুক ও হাসপাতালের সহকারী সাইফুলের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এরপর কিশোরীর বাবা জয়নাল শেখ গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে সিএমএম আদালতে নারাজি দেন। ওই নারাজিতে বলা হয়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সঠিকভাবে তদন্ত করেননি। মামলার আসামি রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি মেজবাউল ও চিকিৎসক নাসির উদ্দিন নানাভাবে আপস করার জন্য তাকে চাপ প্রয়োগ করেছেন। আপস না করায় ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ করে বাদীকে হত্যার হুমকিও দেয়। আর তার মেয়ে জান্নাত ফেরুদৌসকে চিকিৎসার কথা বলে অপারেশন থিয়েটার নিয়ে ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এর দায় এড়াতে পারে না। আর আবেদন আদালত গ্রহণ করে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের তদন্তেও কিশোরী জান্নাতুল ফেরদৌসকে খুন করা হয়েছে। এই খুনের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া চিকিৎসক ফারুক হোসেন, চিকিৎসক নাসির উদ্দিন, এমডি মেজবাউল আলম এবং হাসপাতালের সহকারী সাইফুল জড়িত।
এরপর মামলাটি পিবিআই তদন্ত পূর্বক আদালতে অভিযোগপত্র দেন। আর ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালের এমডিসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন। মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেছেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত র‌্যাবের কাছে ফোন এসেছে ১২০টি, ই-মেইলে অভিযোগ এসেছে ২০টি। সব অভিযোগই প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, পাওনা টাকা পরিশোধ না করা প্রসঙ্গে। বেশ কিছু ই-মেইল এসেছে বিদেশ থেকে। আরও দু-তিন দিন সেবা সংযোগটি’ চালু রাখবে র‌্যাব।
তিনি আরো বলেন, সরকারি চাকরি দেওয়া, বদলির তদবির করে টাকা আদায়, পাথর, বালু, রড, সিমেন্ট, বিটুমিন সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ না করা, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করা, ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে টাকা আদায়ের মতো অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করে প্রতিকার চেয়েছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। রোগীদের অভিযোগ হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের। আর এসব অভিযোগকারীদের অধিকাংশই প্রবাসী।
তাছাড়া, মিরপুর, উত্তরা, পূর্বাচল, গাবতলী, খিলগাঁও, কলাবাগান, খিলক্ষেত, শাহজাহানপুর, বনানী ডিওএইচএস, সুনামগঞ্জের ছাতক, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। আর গত রোববার পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছে বলে র‌্যাব জানিয়েছে।


বিজ্ঞাপন