সম্রাট তান্ডবের শেষ কোথায়?

অপরাধ আইন ও আদালত রাজধানী রাজনীতি

কারাগারে বসে নিয়ন্ত্রণে জমি দখল

চাদাঁবাজি বাণিজ্য; নির্দেশ গুম আর হত্যার!

 

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : বহুল আলোচিত ক্যাসিনো কিং ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ এর প্রাক্তণ সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী কারাগারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করছেন দখল ও চাদাঁবাজি বাণিজ্য, প্রয়োজনে নির্দেশ দিচ্ছেন গুম আর হত্যার। ২০১৯ সালের অক্টোবরে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হবার পর থেকে কারাগারে আছেন এই আলোচিত সন্ত্রাসী। আর সেখান থেকেই তার নির্দেশনায় চলছে জমি দখল, বাড়ি দখল সহ বড় অংকের চাদাঁবাজি, গুম, হত্যাসহ বিভিন্ন রকম অবৈধ কর্মকান্ড।


বিজ্ঞাপন

সম্রাট গ্রেফতার হবার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় তার বহুল আলোচিত ক্যাসিনো ব্যবসা। বিভিন্ন সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, গ্রেফতার হবার পর সম্রাট কারাগারে বসে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ‘ভিক্টর’কে নির্দেশ দেন তার নামে চাদাঁবাজি চালিয়ে যেতে। সম্রাটের নির্দেশ পেয়ে তার অনুপস্থিতিতে সহকারি ভিক্টর, আকরাম, জনি, টেন্ডু কামাল রাজধানীর মতিঝিল, মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল নয়াটোলা, মালিবাগ সহ ঢাকা দক্ষিণে চাদাঁবাজি আর দখলের এক ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করে। আর তাদের সকল কর্মকান্ড পেছন থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে স¤্রাট। কারাগার থেকে পাওয়া গোপন তথ্য মতে সম্রাটকে এসব কাজের নিয়ন্ত্রণে খোদ কারাগার পুলিশ, মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং জেল কর্মকর্তারা সহায়তা করছেন।

২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সম্রাট গ্রেফতার হবার পর থেকে পরবর্তী ৬ মাসে সম্রাট বাহিনীর তান্ডবের শিকার হয়েছে প্রায় ৬০ টির ও অধিক পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দাবীকৃত চাদাঁ’র টাকা না দেওয়ায় রাজধানীর শান্তিনগরে সম্রাটের সহযোগী টেন্ডু কামালের হাতে নিহত হয়েছেন পোল্ট্রি ফার্ম ব্যবসায়ী দম্পতি। জানুয়ারী, ২০২০ সালে চাদাঁ না পেয়ে কাকরাইলে শফিক হত্যা, ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সালে মগবাজারে বাড়ি দখলের উদ্দেশ্যে নার্গিস হত্যা সংগঠিত হয় সম্রাটের নির্দেশে। বিভিন্ন সময়ে চাদাঁবাজি আর দখল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্তে সম্রাট অসুস্থতার দোহাই দিয়ে কারাগার থেকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে বসে চাদাবাজি এবং দখল বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা যায়। কাংক্ষিত টাকা না পেলে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার নির্দেশনাও সম্রাটের কাছ থেকে আসতো বলে সূত্র নিশ্চিত করে।

বিগত এক বছরে সম্রাট বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়েছেন, চাদাঁর টাকা দিয়েও নির্যাতিত হয়েছেন এমন অনেকেই প্রাণ বাচাঁতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। মগবাজার, শান্তিনগর, কাকরাইল নয়াটোলা, মালিবাগ এলাকায় ঘুরে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্রাটের অনুপস্থিতিতে তার অনুসারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সম্রাট গ্রেফতার হবার পরপরই ভিক্টর, জনি, টেন্ডু কামালের হাতে অপহৃত হন বেশ কয়েকজন। এদের মধ্যে মালিবাগের ট্রেডিং ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, কুয়েত প্রবাসী ইনাম আহমেদ, শান্তিবাগের জমির উদ্দিন বড় অংকের চাদাঁ দিয়ে জীবিত ফেরত এলেও শান্তিবাগের সমাজকর্মী জাহানারা, মতিঝিলের পরিবহন ব্যবসায়ী আরিফ রহমান সহ আরও বেশ কয়েকজন এখনো নিখোঁজ বলে জানা যায়।

বিগত ০৮ বছর ধরে অবাধে চলছে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এর দখল বাণিজ্য এবং চাদাঁবাজি। বিভিন্ন সময়ে সম্রাট এবং তার বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৭ জন। গুম হয়েছেন ৫০ জনেরও অধিক মানুষ যাদের অনেকেরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে আরামবাগে করিম হত্যা, ২০১৩ সালে মতিঝিলে লিয়াকত হোসেন হত্যা, কাকরাইলে বাসেত হত্যা, ২০১৪ সালে পল্টন মোড়ে গুলি করে নাজমা বেগম হত্যা, ২০১৫ সালে মতিঝিলে বাড়ি দখলের জন্য একই পরিবারের ০৩ জনকে পুড়িয়ে হত্যা, ২০১৬ সালে ফারাবি হত্যা এসব ঘটনায় সম্রাট এবং তার বাহিনীর সরাসরি সম্পৃক্তত্তা নিশ্চিত। ২০১৩ সালে স¤্রাটের হাতে মতিঝিলে খুন হওয়া লিয়াকত হোসেনের বোন লাইলুন নাহার ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে দিনে দুপুরে নিজ বাড়িতে সম্রাট এবং তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হন। এগুলো সহ মোট ১১ টি হত্যা মামলা সম্রাটের নামে চলমান যেগুলোর একটি মামলারও চার্জশীট পুলিশ আজ পর্যন্ত দাখিল করেনি। এছাড়াও শতাধিক চাদাঁবাজির অভিযোগ/ মামলা আজও অবধি ফাইল বন্দি।

বিগত এক বছরে যারা সম্রাট বাহিনীর দাবীকৃত চাদাঁর টাকা শোধ করেছেন তাদের প্রায় সবাই জীবন বাচাঁতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সম্রাট বাহিনী রাজধানীর নয়াটোলা মগবাজারে কুয়েত প্রবাসী জিনাত ইনামকে দিনে দুপুরে বাসায় ঢুকে হামলা করে এবং সর্ণালংকার লুটপাট করে। এর একদিন পর, জিনাত ইনামের স্বামী ইনাম আহমেদ সম্রাট বাহিনীর হাতে অপহৃত হন এবং ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে বাধ্য হন। এর আগে ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে অবৈধভাবে সম্পত্তি দখলকে কেন্দ্র করে সম্রাট এবং তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে জিনাত ইনামের ভাই লিয়াকত হোসেন এবং বোন লাইলুন নাহার খুন হন।

জিনাত ইনাম জীবন বাচাঁতে পরিবার নিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই দেশ ছেড়েছেন। পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা নিচ্ছেন না কেনো; এমন প্রশ্নের উত্তরে ভুক্তভোগীদের আত্মীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্তব্য করেছেন, ‘পুলিশ কি সহোযিতা করবে আমাদের? পুলিশ তো তাদের পকেটে, তাদের কথায় উঠবোস করে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ নিয়ে গেলে উল্টো পুলিশ সম্রাট বাহিনীকে সব খবর দিয়ে দেয়। তখনতো মাল এর সাথে সাথে জানও চলে যায়, তাইতো হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে, সম্রাটের হাতে অনেকে মারা পরসে, একটারও কি বিচার হইসে? হয় নাই। আর কোনোদিন হবেও না। ক্যাসিনো মামলায় ওরে জেলে নেসে, কারণ ও তো মন্ত্রী মিনিষ্টাররেও মানে নাই। তাগো কোটি কোটি টাকা, জমি জিরাত খায়া বইসে আসে। মন্ত্রীরা তাদের সেইসব অবৈধ টাকা, সম্পদ উদ্ধারের জন্য ওরে জেলে নেসে। দেশে সুষ্ঠ বিচার বইলা কিছু নাই, থাকলে একটা রাজনৈতিক সন্ত্রাসী এমন বছরের পর বছর টান্ডব চালাইতে পারে না।’

যাকে সরকার এবং মিডিয়া পরিচিত করেছে ‘ক্যাসিনো কিং’ হিসেবে সেই ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট রাজনৈতিক আর পুলিশ প্রশাসনের মদদে বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে এসেছে জমি দখল, চাদাঁবাজি। মতের অমিলে নির্দিধ্বায় করেছে খুন, অত্যাচার, নির্যাতন। ২০১৯ সালে সম্রাট গ্রেফতার হবার পর অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তনতো হয়নি বরং আরও ভয়াবহ হয়েছে। কারাগারের ভেতরে বসেই সম্রাট নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছেন তার অবৈধ দখল, চাদাঁবাজি, প্রয়োজনে নির্দেশ দিচ্ছেন গুম কিংবা হত্যার।

সবার এখন একটাই প্রশ্ন, সম্রাটের এই তান্ডবের শেষ কোথায়?