বস্তি নিয়ন্ত্রণ করে কোটিপতি!

অপরাধ এইমাত্র রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক : বস্তির জীবন এবং জীবিকা দুটোতেই যেন অনিশ্চয়তার দোলাচল। ভাসমান জীবনে খড়কুটো ধরে আঁকড়ে বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা বস্তিবাসীর। বেঁচে থাকার তাগিদে পরিবার নিয়ে ঢাকার বস্তিতে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন হতভাগ্যরা। অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর আর গিঞ্জি বস্তিতে ঠাঁই হলেও অভাব ওদের পিছু ছাড়ে না। জীবিকার তাগিদে বাস-ট্রাক, রিকশা ও বেবিট্যাক্সি চালানো, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিকের চাকরি, রাজমিস্ত্রি, গৃহকর্মী, ছোট মুদি দোকানসহ নি¤œ আয়ের বিভিন্ন পেশা বেছে নেন তারা। এসব কাজ করে যে সামান্য আয় হয় তার সিংহভাগ চলে যায় তথাকথিত বস্তির মালিক ও সেখানে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটের পকেটে।
যদিও বস্তির জায়গা সরকারের তবুও ঘরভাড়াসহ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের অবৈধ বিলের নামে একেকটি বস্তি থেকে মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, বস্তির নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মধ্যে ঘটে খুনোখুনির ঘটনাও। কিন্তু তাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যেন কেউ নেই। নির্বিকার প্রশাসনসংশ্লিষ্টরা। কারণ তথাকথিত বস্তির মালিক ও সিন্ডিকেটের ওপর রয়েছে রাজনৈতিক নেতাসহ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশীর্বাদ। রাজধানীর কড়াইল, মহাখালীর সাততলা, ভাসানটেক, তেজগাঁও রেলওয়ে, মিরপুরের ঝিলপাড় এবং মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ী বস্তিতে সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ঢাকা শহরের বস্তিতে মোট খানা বা ঘর বা পরিবার রয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩০টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৬৩৯টি, মোট খানা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮০টি ও জনসংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বস্তির সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৫টি, খানার সংখ্যা ৪০ হাজার ৫৯১টি ও জনসংখ্যা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ি এ তথ্য জানা যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর কল্যাণপুরে গণপূর্ত বিভাগের জমিতে একটি বস্তি গড়ে উঠেছে কয়েক দশক ধরে। এখানে ঘর আছে অন্তত চার হাজার। আর বসবাস করে লক্ষাধিক মানুষ। অবৈধ গ্যাস, বিদুৎ, পানিসহ সব সুবিধাই আছে এখানে। ব্যবসাও রমরমা। নিয়ন্ত্রণকারীদের মাসে আয় হয় কয়েক কোটি টাকা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কল্যাণপুর বস্তিতে ঘর আছে পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রভাবশালী, দলবাজ, পাতি মাস্তান আর মাদক ব্যবসায়িদের। কেউ ১০টি ঘরের মালিক। কারো আছে শতাধিক ঘর। বস্তিতে ঢুকতেই দেখা যায় বেশ কিছু আধাপাকা ঘর। বস্তিবাসীর তথ্য মতে ঘরগুলোর মালিক দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা।
অপরদিকে, ৪ নম্বর পোড়া বস্তিতে কথিত মাদক ব্যবসায়ি লাদেন বাচ্চুর অন্তত ৭০টি ঘর রয়েছে এখানে। পুকুর ভরাট করে তিনি এসব ঘর তুলেছেন। পুকুর ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবাই ভরাট করেছে তাই তিনিও করেছেন। আর মাদক ব্যবসার বিষয়ে তিনি বলেন, আগে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এখন আর তিনি এ কাজ করেন না। এই বস্তিতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারি মজিবরের রয়েছে ৬০ থেকে ৭০টি ঘর। সিটি কর্পোরেশনের প্রভাব খাটিয়ে প্রতি মাসে এসব ঘর থেকে কয়েক লাখ টাকা আয় করেন মজিবর। তবে তিনি ৩০টি ঘরের মালিক বলে স্বীকার করেন।
বস্তিতে রিণা নামের দুই প্রভাবশালীর অনেক ঘর থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ক্ষেপে যান তারা। একই বস্তিতে শতাধিক ঘর রয়েছে এক কথিত নেতার। এছাড়াও প্রবাভশালী অনেক নেতাই এ বস্তির টাকায় নিজের পকেট ভারি করছেন।
মিরপুরের চলন্তিকা বস্তির চিত্র আরো ভয়াবহ। সম্প্রতিতে ভয়াবহ আগুনে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এখানে ৪৫ বছর ধরে বাস করছেন মকবুল নামে এক বৃদ্ধ। তার মতে অনেক মানুষ এখানে যুগ যুগ পার করেছেন। এখন বসবাস করছেন খোলা আকাশের নিচে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফকির কবির আহমেদ নামে এক ব্যক্তি এক সময় বস্তিবাসি হলেও এখন রূপনগরে একাধিক বাড়ির মালিক তিনি।
তার বাড়িটির কিছু অংশ নির্মাণ করা হয়েছে ঝিলের জায়গা দখল করে। বাড়ির পিছনে এখনো কয়েকশ ঘর তুলে গ্যাস, বিদুৎ, পানি দিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। থানার পাশে একটি, ৫ নম্বর রোডে একটি বাড়ি এবং ওয়াসার পাশে দোকান ও প্লট রয়েছে ফকির কবির আহমেদের। যদিও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।
ডিস বাবু, বস্তিতে দুই শতাধিক ঘর তার দখলে। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকার আয় দিয়ে বস্তির একটু দূরে ৬ তলা বাড়ির মালিক এক সময়ের এই বস্তির-বাসিন্দা। তিনি জানান, শুধু আমি না, অনেক রাঘব বোয়াল বস্তি ব্যবসায় জড়িত। খলিলুর রহমান ওরফে বাইট্টা খলিল। তিনিও বস্তির দুই শতাধিক ঘর নিয়ন্ত্রণ করেন। সেই টাকায় গড়ে তুলেছেন চারতলা বাড়ি। একই রাস্তায় বাইট্টা খলিলের ভাই হেলাল মিয়ারও একটি পাঁচতলা বাড়ি আছে। দুই ভাই মিলে তিন শতাধিক ঘর নিয়ন্ত্রণ করতেন এই পোড়া বস্তিতে।
বস্তির শতাধিক ঘর দখল করে ছিলেন আক্তার মিয়া। প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা আসতো এখান থেকে। সে টাকা দিয়ে তিনিও রাতারাতি ধনকুবের হয়েছেন। এছাড়াও বস্তির টাকায় যারা গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো তুহিন। তার রয়েছে ৬১টি ঘর। সোহেল নামের এক ব্যক্তির ১৫০টি, জুট ব্যবসায়ি মানিকের শতাধিক ও ডিস রকির দখলে ২৫০টি বস্তিঘর রয়েছে। প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা আসে ডিস রকির। এ টাকা দিয়ে তিনিও গড়েছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি।
মিরপুর রূপনগরে যে বস্তিগুলো রয়েছে সেখান থেকে মাসে অন্তত দুই কোটি টাকা আয় হয়। এর অধিকাংশ যায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের পকেটে। স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ড কমিশনার রজব আলী নিজ বাড়ির সামনেই গড়ে তুলেছেন বস্তি। প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা তার পকেটে যায়। অন্তত শত কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা বাড়ি তার অবৈধ আয়ের স্বাক্ষী।
রাজধানীর করাইল বস্তি। এখানে অন্তত দশ হাজার ঘর রয়েছে। লক্ষাধিক মানুষের বসবাস এ বস্তিতে। রয়েছে অবৈধ্য গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন। প্রতি মাসে কোটি টাকা তুলে ভাগ বণ্টন করে নেয় স্থানীয় ক্ষমতাশালীরা। এখানে গ্যাস লাইনের অবৈধ সংযোগ দেন কয়েকজন। মমিন, মনজুরুল হক, মোস্তফা, সোবহান মাওলানা, রফিকসহ কয়েকজন। মমিনের জন্মও এ বস্তিতে। গত তিন দশক এখানে থেকেছেন এক সময়ের বিএনপি নেতা মমিন। নিজের দখলে রেখেছেন প্রায় ৫০টি বস্তিঘর। এখান থেকে আসে কয়েক লাখ টাকা। এছাড়া অবৈধ গ্যাসের লাইন আর ডিস ব্যবসা করে গুলশানে কিনেছেন ফ্ল্যাট। সোবহান মাওলানার দখলে শতাধিক ঘর। বস্তির অবৈধ গ্যাস সংযোগের সঙ্গে জড়িত মনজুর। যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি তাকে।
খিলগাঁয়ে ঝিল ও জমি দখল করে তৈরি হয়েছে শত শত ঘর। ব্যতিক্রম নয়, রেলওয়ে কলোনিও। অন্যদিকে শাজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি। নাম কলোনি হলেও ভেতরে শত শত বস্তি ঘর। রেলের ভবনগুলোর সামনে খোলা জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব বস্তির টাকায় বিত্তশালী হয়েছেন।
রেল কর্মচারি রুস্তুম একটি ঘর পেয়েছেন সরকারি ভাবে। সেই ঘরের চারদিকে অন্তত ১২টি ঘর করে ভাড়া দিয়েছেন তিনি। একই অবস্থা মোশারফেরও। তিনিও সরকারিভাবে একটি ঘর পেয়েছেন। অতিরিক্ত ঘর বানানো হয়েছে দশটি। এসব ঘরে অবৈধভাবে দেয়া হয়েছে গ্যাস ও বিদুতের সংযোগ। শুধু এ দুজনই নয়, কলোনিতে যারাই ঘর পেয়েছেন, তারাই বস্তি বানিয়েছেন। তবে, কর্মচারির বাইরে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও রেলের জমি দখল করে বস্তি বানিয়েছেন। শরীফ আহমেদ। তিনি কলোনিতে বেশ কয়েকটি ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। এছাড়া বড় একটি জায়গা দখল করে রিকশার গ্যারেজ বানিয়েছেন। সরকারি জায়গা দখল করে এগুলো করা ঠিক কী-না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি বাধ্য না।
খিলগাওয়ে সরকারি জমি দখল করে শহীদের নামে বস্তি করা হয়েছে। বিশাল এলাকা জুড়ে কয়েকশ’ ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছেন তারা। বস্তিবাসী জানান, নোংরা পরিবেশ বস্তিতে। কোন সুযোগ সুবিধা ছাড়াই দুই থেকে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। বস্তির বেশীর ভাগ ঘরই তিন ভাইয়ের দখলে। এখানে শহীদের বাড়ি থেকে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রতি মাসে, বস্তির আয় দিয়ে তাদের আয়েসী জীবন। তৈরি করেছেন পাঁচতলা বাড়ি। এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য শহীদ, মালেক, খালেক ও রহমানকে পাওয়া যায়নি। তবে শহীদের মা দাবি করেন জমির মালিক নাকি তার শাশুরি।
উল্লেখ্য, সরকারি জায়গায় ঘর নির্মান করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলও বস্তি। ভাড়াটে খুনিরা খুন করে বস্তিতে এসে আত্মগোপন করেন। শুধু তাই নয়, ঢাকার বাইরে থেকে আসা অস্ত্র ও মাদকের ট্রানজিট পয়েন্টে পরিণত হয়েছে কোনো কোনো বস্তি। এসব কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক বস্তিবাসী হয়ে উঠছে ভয়ংকর অপরাধী। কেউ কেউ বনে যাচ্ছে গডফাদার। একসময় তাদের অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। কিন্তু অপরাধ জগতে নাম লিখিয়ে এ মুহূর্তে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক তারা। এভাবেই ঢাকার একেকটি বস্তি যেন ‘অপরাধী তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে।


বিজ্ঞাপন