আবারো ডেঙ্গুর হানা

জাতীয় জীবন-যাপন স্বাস্থ্য

বাড়ছে মশার লার্ভা!


বিজ্ঞাপন

 

বিশেষ প্রতিবেদক : করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। করোনার আগ্রাসী থাবায় যখন পুরো দেশের মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তখন ঘরেও অন্য এক আতংকের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ছে সবাই। এই রোদ, এই বৃষ্টির এমন আবহাওয়ায় ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়ার আশংকা বেড়ে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ছে মশার লার্ভা। দেশের হাসপাতালগুলো এখন করোনা রোগী নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে প্রায় চার গুণ। তবে এপ্রিল ও মে মাসে করোনা আতংকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন কম, তাই স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও কম। কিন্তু আসলেই কি কমেছে ডেঙ্গু রোগী? বাস্তবে রোগীরা ঘরেই থাকায় ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও তার হিসাব তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না।
তার থেকেও ভয়ের কথা, গত বছরে প্রথম তিন মাসে ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ছিল গড়ে পাঁচ। আর একই সময়ে চলতি বছর ঘনত্ব ১০। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও এডিস মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের রকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এদিকে, রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় চারজন রোগী হাসপতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সন্দেহে একজনের তথ্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। তবে আইইডিসিআর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই মৃত্যু ডেঙ্গুজনিত নয় বলে নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের অন্যান্য বিভাগের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নতুন কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। এমনকি ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি নেই ঢাকার বাইরে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৭৩ জন। তাদের মধ্যে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৩৬৩ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের মধ্যে রাজধানীতে ৫১ হাজার ৮১০ জন এবং রাজধানীর বাইরে ৪৯ হাজার ৫৪৪ জন। এ ছাড়া ওই বছর অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে ডেঙ্গু সন্দেহে ২৬৬টি মৃত্যুর তথ্য আসে। এদের মধ্যে ২৩৪টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটি।
অপরদিকে, রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এ পর্যন্ত অন্তত ২৬ জেলায় তিনশতাধিক ডেঙ্গু রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
নাটোর: নাটোরে ৭ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। আক্রান্তরা সবাই ঢাকা থেকে নাটোরে এসেছে। সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম জানান, তারা পরীক্ষা উপকরণ সংগ্রহের জন্য আজই ঢাকায় লোক পাঠাবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত ছয়জন রোগী চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে শনিবার ৩ জন এবং রবিবার ৩ জন রোগী ভর্তি হয়। জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চোধুরী জানান, সদর হাসপাতালে ভর্তি ৬ জনই নিশ্চিতভাবেই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত।
কুমিল্লা : কুমিল্লার হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এ পর্যন্ত ৩০ জনে পৌঁছেছে। ঢাকা থেকে জ্বর নিয়ে আসা এ সকল রোগী কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। বর্তমানে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন আছেন ১৭ জন।
যশোর: যশোরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শনিবার বিকাল পর্যন্ত ২৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ১৯ জুলাই যশোর ইবনে সিনা হাসপাতালের আইসিইউ থেকে ঢাকা নেয়ার পথে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া রাণী (৫৩) নামে এক রোগী মারা যান। তিনি নড়াইল সদর উপজেলার কুড়িগ্রামের আবদুর রাজ্জাকের মেয়ে।
চুয়াডাঙ্গা: জেলা সদর হাসপাতালে এক নারীসহ ৪ জন ডেঙ্গু রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তারা সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরআগে চিকিৎসা নিয়েছেন আরও এক নারী। শনিবার রাত থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত তারা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন।
শেরপুর: শেরপুর জেলা হাসপাতালে রবিবার দুপুর পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর আগে আরও তিনজন জেলা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এ নিয়ে ৫ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হলো।
চাঁদপুর: চাঁদপুরে নতুন করে পাঁচজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর আগে ৩ নারীসহ ১৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী চাঁদপুর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. নাজমুল হক জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা চলছে।
খুলনা: খুলনা, যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও বাগেরহাটে চলতি মাসের ২২ দিনে ৭১ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪ জন, খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়জন ও গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনজন ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত দুজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেলেও স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে তাদের মৃত্যু যে ডেঙ্গুর কারণেই হয়েছে তা নিশ্চিত না। খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ৩ জুলাই বিভাগীয় পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগের তথ্য সংরক্ষণের জন্য সেল খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৭১ জন শনাক্ত হয়েছেন।
চট্টগ্রাম: বন্দরনগরীতে ১৫ দিনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব মতে, প্রতিদিন গড়ে পাঁচজন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে নগরীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪৯ জন রোগী শনাক্ত করেছে সিভিল সার্জন অফিস। তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
ফেনী: সদর হাসপাতালে গত ১৫ দিনে ৪৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ২১ জন এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ছয়জনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। আর ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন একজন রোগী। অন্য চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
রংপুর: গত আট দিনে ২১ জন রোগী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তরা সবাই ঢাকায় থাকতেন। সেখানেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. সুলতান আহমেদ জানান, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
পিরোজপুর: স্বরূপকাঠি উপজেলায় একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে শনিবার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন। আক্রান্ত নুর ইসলাম রাহুতকাঠী গ্রামের বাসিন্দা।
পাবনা: সদর হাসপাতালে চার দিনে ১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের বেশির ভাগই ঢাকায় ছিলেন। তারা জানান, রাজধানী থেকে ফেরার পরই তারা জ্বরে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসকের কাছে গেলে রক্ত পরীক্ষা করে তাদের ডেঙ্গু ধরা পড়ে।
লক্ষ্মীপুর: সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, শনিবার বিকাল পর্যন্ত ছয়জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় হোসেন আহমেদ নামে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কক্সবাজার: জেলার মেধাবী ছাত্রী উকিনো নুশাং (১৯)-এর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গত শনিবার চিকিৎসকের পরামর্শে সদর হাসপাতাল থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে বিকালে তিনি মারা যান।
বরগুনা: বরগুনায় ১৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের ডেঙ্গু আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করেছেন।
মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারেও ধীরে ধীরে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী। গেল দুই সপ্তাহ আগে এক থেকে দুজন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত থাকলেও এখন এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ জনে।
রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. শওকত আকবর জানান, রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে দুজন মহিলা ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। দুই একটা ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়ায় আতংক হওয়ার কিছু নেই। তবে সবাইকে অবশ্যই সতর্কতার সাথে থাকতে হবে। এছাড়া বগুড়ায় সাংবাদিকসহ ১৫ জন এবং সাতক্ষীরায় ৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, মশা মারার কার্যকর ওষুধের স্বল্পতা, ওষুধ না ছিটানো, জনবলের অভাব এসব পুরানো সমস্যা তো আছেই। শুধু দেখানোর জন্য যত্রতত্র ফগিং করা নয়, বরং ফগিং করে মশা মরছে বা কমছে কিনা তা মনিটরিং করতে হবে নিয়মিতভাবে। ডেঙ্গু যেন এ বছর আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে, এ জন্য মশা দমন ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। নয়তো করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুতেও মৃত্যুর মিছিল শুধু দীর্ঘই হতে থাকবে।