হাতের লেখা

সাহিত্য

কাজী আরিফ : মনোরঞ্জন স্যারের সাইজ ছোটখাট মৈনাক পর্বতের মত।
স্যার যখন থপ থপ করে ক্লাস রুমের মধ্যে বা পরীক্ষার হলে হাঁটাহাঁটি করেন তখন যেন দুনিয়া কাঁপতে থাকে। ্স্যারের হাত দুখানা দুটো আস্ত মুগুরের মত ।আর যখন কথা বলে মনে হয় কেয়ামতের শিংগায় ফুঁক পড়েছে।আমরা তখন পাপীতাপী বান্দার মত কৃত পাপকর্মের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম। মনে হত স্কুলের ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বা খোলা জনালা দিয়ে লাফ দিয়ে পগার পার হয়ে দূরে চলে যাই। উনি নির্ঘাত ধরতে পারবেন না। সমস্যা হল, উনি দফতরি বক্কারকে দিয়ে ধরিয়ে এনে আশরাফদের বাঁশ বাগানের কঞ্চি দিয়ে পিঠে পশ্চাতে পালিশ করে দেবেন।
মনোরঞ্জন স্যারের কথা বলতেই পালিশ দেয়ার বড় কারিগরের কথা মনে পড়ে যায়।


বিজ্ঞাপন

গাজী সাহেব। স্কুলে দুজন গাজী ।একজন আলতাফ গাজী অন্যজন সাত্তার গাজী। আলতাফ গাজীর শুধুই ভয়ের তাপ। আচরন হিটলারের নাজী বাহিনীর মত।
ধর এবং মারো পদ্ধতিতে চলেন।মাইরের উপর ঔষধ নাই এই থিওরীর আধুনিক প্রবক্তা তিনি। তিনি গাজী থেকে পুরো নাজী হয়ে গেছেন। তাকে এক রাস্তায় দেখে অন্য রাস্তায় চলে যাই।

আমরা দিনের পর দিন এহেন নাজী টাইপ গাজী আর মৈনাক পর্বতের নীচে পিষ্ট হচ্ছিলাম।

এর মধ্যে নাজীর উত্তম পালিশ খেয়ে দু একজন স্কুল ছেড়ে দিয়ে সৈনিক জীবনে নাম লিখিয়েছে। এভাবে মার খাওয়ার থেকে সেনাবাহিনীর পানিশমেন্টকে তারা সহজ মনে করেছিল।আর অনেকে এই মার খাওয়ার দুঃখে স্কুলের রাস্তাই ভুলে গেছিল। পরে তাদের পিতৃদেবের নাম ভুলেছিল কিনা জানিনা ।

একদিন হোম টাস্কের খাতা নিয়ে মনোরঞ্জন স্যার আমায় ডাকলেন। ঠিক ডাকা নয়, হুংকার দিলেন। আত্মা আমার গলার কাছে এসে আটকে আছে।

‘এটা কি লিখেছিস গাধা ? হাতের লেখা চীন দেশ থেকে আমদানি করেছিস? নাকি দোয়াতের মধ্যে তেলাপোকা ভিজিয়ে খাতার উপর ছেড়ে দিয়েছিস ? এদিকে আয়। কি লিখেছিস পড়ে দিয়ে যা’

ভীষন ভয় নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কাছে গেলাম। কেউ যদি মনোরঞ্জন স্যারকে ভয় পেয়ে কাঁপাকাঁপি করত তাহলে তিনি খুব খুশি হতেন ।ভয় পাওয়া নিয়ে কথা তাই কোন অস্ত্রের ব্যবহার না করে খাতা ছুড়ে দিলেন।
আমি টালমাটাল হয়ে খাতাটা ক্যাচ ধরলাম।

নিজের খাতা পড়ার চেষ্টা করলাম। দেখি সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। হিজিবিজি কি লিখেছি পড়তে পারছিনা।
তাও পড়লাম অনেক কষ্টে ।স্যার বললেন,

‘তুই কি কাউকে চিঠি লিখে তার বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে আসবিরে গাধা। দশ দিনের মধ্যে হাতের লেখা ভাল করবি ।না হলে তোকে চেয়ার বানিয়ে আমি ঘাড়ের উপর বসে ক্লাস নেব’

সারা ক্লাসের সে কি হাসি ! ওই পাহাড় আমার ছোট কাঁধে বসলে আমার কি অবস্থা হবে !

আমার মুখ শুকিয়ে আমচুর।
কিভাবে দশ দিনে হাতের লেখা ভাল করব ??
এরপর শুরু হল তেলাপোকার হাত পায়ের মত লেখা ফেলে হাতের লেখা সুন্দর করার আপ্রান চেষ্টা আমার। দিনরাত এক করে সে কি প্রচেষ্টা ।

এলাকায় যাদের হাতের লেখা ভালো বলে বিবেচিত তাদের হাতের লেখা এনে কপি করতে লাগলাম। হটাৎ আমার ঘনিষ্ট বন্ধু শাহজাহান বুদ্ধি করে বলল,
‘তুই বরং ফারিয়াকে একটা প্রেমের চিঠি দে। হাতের লেখার প্রাকটিস হবে’

আমার আবার সাহিত্য ভাল যায়। শাহজাহানের বুদ্ধিতে আমার মাথায় চমক খেলে গেল।বন্ধু আমার ভাল আইডিয়া দিয়েছে। চমৎকার একটা চিঠি লিখতে হবে যাতে করে ফারিয়া আমার প্রেমে হাবুডুবু খায়।

যেই কথা সেই কাজ – – – – –
দশদিন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পত্র সাহিত্যে মনোনিবেশ।
গীতাঞ্জলী, গীতবিতান, সঞ্চিতা, সঞ্চয়িতা সব নিয়ে বসলাম ।

কয়েক দিস্তা কাগজ লিখে লিখে মানে প্রাকটিস করে শেষ করলাম। শেষে প্রেমপত্রের একখানা মাস্টারপিস লিখে ফেললাম যার ছত্রে ছত্রে কবিতা, গান, আবেগ – –
‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে এমন সব লাইনে ঠাসা একখানা পত্র।
চিঠির প্রেমে নিজেই পড়ে গেলাম। অমন চিঠি আমায় দিলে আমিই প্রেমে পড়ে যেতাম।

একটা তাজা গোলাপ এক বাড়ি থেকে চুরি করলাম বহু কাঠখড় পুড়িয়ে।
সেটা চিঠির মধ্যে দিয়ে ,সেন্ট এর স্প্রে করে ,লালনীল পেন্সিল দিয়ে ফুলপাতা এঁকে একটা খামে ঢুকিয়ে ফারিয়াকে দেবার ব্যবস্থা করলাম।

ফারিয়ার কথা বলি।
ফারিয়া সুন্দরী কিন্ত বড্ড ঠোঁট কাটা । ঝগড়াটে । কিন্ত দেখতে আসলেই সুন্দর।
গোলাপের নীচে কাঁটা থাকে যেমন তেমনি সুন্দরের সাথে অসুন্দর বাস করে। ফারিয়ার মত সুন্দরী মেয়ে যে এতটা হৃদয়হীনা হবে বুঝতে পারিনি । সে চিঠিখানা হাসিমুখে গ্রহন করে প্রথম ক্লাসেই মৈনাক পর্বতের হাতে দিয়ে মুচকি হেসে আমাকে দেখিয়ে স্যারকে বলল, ‘স্যার, ও আমার সাথে লাইন করার জন্য এই চিঠি দিয়েছে’

মনোরঞ্জন স্যারকে যতই মৈনাক পর্বত বলি কিন্ত তিনি ফারিয়ার মত হৃদয়হীনা ছিলেন না। তার বড় দেহের মতই কলিজাখানাও বড় ছিল। তিনি সবার সামনে চিঠি বের করলেন। অমনি ঝুর ঝুর করে গোলাপের পাপড়ীগুলো খসে পড়ল।
সারা ক্লাস ক্লাইমেক্সে টানটান উত্তেজনা নিয়ে ঘটনাটা দেখছে। ফারিয়া বিজয়ের হাসি হাসছে।
আমি মনে মনে বলছি ‘ধরনী দ্বিধা হও’ আর ভাবছি দফতরী বক্কার বোধহয় এতক্ষনে বাশের কঞ্চি কাটতে চলে গেছে। কিন্ত না , ধরনী দ্বিধা হল।

স্যার মুচকী হেসে চিঠিখানা তার পকেটে রেখে বললেন,

‘ চিঠিটা আমার কাছে রেখে দিচ্ছি। তোর হাতের লেখার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। প্রেমের চিঠি লিখতে গিয়েই আসলে হাতের লেখা সুন্দর হয়েছে। এখন থেকে পরীক্ষার খাতায় এমন হাতের লেখা চাই। তা না হলে কঞ্চির পালিশের কোন মাফ নেই’

সেদিন হাতের লেখার সার্টিফিকেট পেয়ে আর কঞ্চির পালিশ থেকে বেঁচেছিলাম বলে এর পর যে কত প্রেমপত্র লিখেছি তার হিসাব নাই। নিজের প্রেমের চিঠির সাথেও দেদারসে অন্যের জন্যেও লিখেছি।
বিনিময়ে পেয়েছি একটা ভাল হাতের লেখা।

মোরাল অফ দ্য স্টোরিঃ ভাল হাতের লেখা করতে চাইলে প্রেমে পড়া বা প্রেমের চিঠি লেখা আবশ্যক।