কেস স্লিপই বৈধতা?

এইমাত্র জাতীয় রাজধানী সারাদেশ

সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। বাস, টেম্পো, মাইক্রোবাস, হিউম্যান হলারসহ বেশিরভাগ যানবাহনের নেই ফিটনেস সনদ। কেস স্লিপ দিয়েই চলছে বেশির ভাগ বাস। আর এসব গাড়ির কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে হতাহতের তালিকা এবং সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমান আদালত কর্তৃক বিভিন্ন অভিযান চালানো হলেও তা কোন কাজে আসছে না। দূর হচ্ছেনা বিশৃঙ্খলা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাজার হাজার গাড়ি কেস স্লিপ নিয়ে অবাধে চলাচল করছে সড়কে। ট্রাফিক বা ম্যাজিস্ট্রেট এসব অবৈধ গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলে কেস স্লিপ দেখালেই তারা গাড়ি ছেড়ে দেয়। তাই চালকরা ইচ্ছা করেই গাড়ির নামে মামলা করিয়ে সে কাগজ সাথে নিয়েই চলাচল করে দিনের পর দিন। এতে সড়কে চলাচল করতে অন্যকোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনাগুলোয় অন্যান্য কারণের মধ্যে অনুপযোগী গাড়ি অন্যতম। অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনার ১২টি কারণের অন্যতম ফিটনেসবিহীন যানবাহন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান জোরদার করে পুলিশ ও বিএরটিএ। তখন অবস্থার পরিবর্তন হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সড়কে ফেরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। তারা বলছে, সড়কে চলাচলকারী বেশিরভাগ যানবাহনের মালিক প্রভাবশালী। এদের অনেকে রাজনীতি করেন। এসব প্রভাবশালী ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হলেও নবায়ন করেন না।
এদিকে ফিটনেসবিহীন গাড়ি সড়কে প্রাণহানির বড় একটি কারণ হওয়ায় বিআরটিএ ১০ বছরের বেশি সময় ফিটনেসবিহীন মোটরযান চলাচল বন্ধ করতে চাচ্ছে। এজন্য সংস্থাটি গত ৩০ জুনের মধ্যে ফিটনেস নবায়নের নির্দেশনা দিয়েছিল। সঙ্গে ওই সময়ের মধ্যে নবায়ন না করলে নিবন্ধন বাতিলের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু মালিক ও চালকদের থেকে ফিটনেস নবায়নে তেমন সাড়া মেলেনি বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে ফিটনেস দেখভাল করার জন্য বিআরটিএতে নেই পর্যাপ্ত পরিদর্শক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, সারা দেশে ৪ লাখের ৭৯ হাজার ৩২০টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে। যানবাহনের সংখ্যা অনুযায়ী বিআরটিএতে ফিটনেস দেখভালে পাঁচ শতাধিক মোটরযান পরিদর্শক থাকার কথা থাকলেও আছেন পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ফলে লোকবলের অভাবে সঠিকভাবে ফিটনেস পরীক্ষা সম্ভব হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, পরিবহন শ্রমিক নেতাদের চাপ, আইন প্রয়োগের ধারাবাহিক শক্ত অবস্থান না থাকা এবং বিআরটিএর জনবল সংকট ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতায় লক্ষ্য এমন হচ্ছে। বিআরটিএর ঢাকার মিরপুর ছাড়া অন্যান্য কার্যালয়ে ফিটনেস পরীক্ষার যন্ত্র নেই। ফলে মোটরযান পরিদর্শকরা শুধু চোখ দিয়ে দেখেই গাড়ির উপযুক্ততা পরীক্ষা করে সনদ (ফিটনেস সনদ) দিচ্ছেন।
বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শকরা জানান, কোনো গাড়ির চলাচলের উপযোগিতা যাচাইয়ে ৩২টি বিষয় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। খালি চোখে এত কিছু পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু গাড়ির বডি, চেসিস নম্বর, ইঞ্জিনের অবস্থা, হেডলাইট ও লুকিং গ্লাস এ ধরনের ছয়-সাতটি অবস্থা দেখে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা যান্ত্রিক উপায়ে করতে ১৯৯৪ সালে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট পাঁচটি সেমি অটোমেটিক ভেহিকল ইন্সপেকশন সেন্টার (ভিআইসি) বা যানবাহন পরীক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে এ পর্যন্ত শুধু বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে এই ধরনের কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
ভ্রাম্যমান আদালত কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে জরিমানা ও গাড়ি জব্দ: এদিকে বিআরটিএ’র ১১টি ভ্রাম্যমান আদালত কর্তৃক মুগদা, গুলশান, গাবতলী, মেট্রো সার্কেল-১, শ্যামপুর, সায়দাবাদ, তেজগাঁও, কলাবাগান, সাভার এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর নতুনব্রীজ, নন্দরহাট, কাজীর দেওড়ী ও সিটি গেইট এলাকায় ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার মাধ্যমে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ ও অন্যান্য আইনের অধীনে ১০২টি মামলায় ১ লক্ষ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে এবং ২২টি মোটরযানের কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে। যেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত মুগদা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৫টি মামলায় ৯ হাজার ৫০০ টাকা; মো. নাজমুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত গুলশান এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৫টি মামলায় ৮ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেলিনা কাজীর নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত গাবতলী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৬টি মামলায় ১৪ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাজিদ আনোয়ারের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত মেট্রো সার্কেল-১ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৭টি মামলায় ২২ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাসুদ হাসানের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত শ্যামপুর ও সায়দাবাদ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৫টি মামলায় ৫ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ সাদিয়া তাজনীনের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত তেজগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৭টি মামলায় ৯ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাছলিমা আক্তারের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত কলাবাগান এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৯টি মামলায় ১২ হাজার ৫০০ টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুবের আলমের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত সাভার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ১৯টি মামলায় ১৬ হাজার ৫০০ টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নূরে জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত মহানগরীর নতুনব্রীজ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৯টি মামলায় ১৩ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শান্তনু কুমার দাসের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত মহানগরীর নন্দীরহাট এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ৮টি মামলায় ৮ হাজার টাকা; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমান আদালত মহানগরীর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন অভিযোগে ২২টি মামলায় ১৬ হাজার টাকা করে জরিমান করে।


বিজ্ঞাপন