পিগালীর জনাকীর্ণ রাস্তায় বিখ্যাত ক্যাফে

অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য

কাজি আরিফ : পিগালীর জনাকীর্ণ রাস্তায় বিখ্যাত ক্যাফে ডি লাইটে বসেছে শাহেদ। ক্যাফেতে মিউজিক বাজছে। দেয়ালের এক পাশে বড় স্ক্রীনে মিউজিক ভিডিও দেখাচ্ছে। চমৎকার দেহবল্লরীর টলটলে নদীর জোয়রের মত এক যুবতী শিল্পি গাইছে, নাম আলিজি। তার গান শুনব নাকি নাকি তাকে দেখবে বুঝতে পারছে না শাহেদ। পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মত তার হাসি, ফ্রেঞ্চ ভাষায় গাইছে- ‘ম – -ললিতা -’ । ভাষা না বুঝলেও মিউজিক ত বুঝতে পারছে । মিউজিকের কোন ভাষা নেই। মিউজিক ইউনিভার্সেল।


বিজ্ঞাপন

শাহেদ প্যারিস এসেছে একজনের খোঁজে।

আসার পেছনে একটা গল্প আছে । সে জয়নাল সাহেবের মেয়েকে খুঁজতে প্যারিস এসেছে। এজন্য জয়নাল সাহেব তাকে পর্যাপ্ত টাকা পয়সা দিয়েছে । হাজার বিশেক ডলার । এবং লাগলে আরো দেবে। এমন মওকা ছাড়া উচিত না বলেই সে লুফে নিয়েছে প্যারিস আসাটা।
জয়নাল সাহেব দেশের অন্যতম শিল্পপতি। দেশে তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে । কিন্ত ইদানিং তার শরীর খারাপ হওয়াতে সন্তানদের নামে সম্পত্তি উইল করে দেবার প্লান করতে চাইছিলেন ।
এমন সময় তার হটাৎ মনে হয়েছে, আরেহ, তার তো আরেকটি সন্তান আছে দেশের বাইরে,প্যারিসে। এই সময়ে তাকে খুঁজে দেখা দরকার। পেছনের দিকে যদি তাকাই দেখতে পাব-

জয়নাল তখন সাহেব হয়নি শুধু ইয়ং জয়নাল তখন, ভাগ্য ফেরাতে ইউরোপে এসেছিল । সেই নব্বইর দশকের প্রথম দিকে । স্মার্ট ছেলে ছিল।খুব দ্রুত ভাষা রপ্ত করে ফেলেছিল।ভাল জব ম্যানেজ করেছিল।
প্যারিসে ছিল বছর চারেক। সেই সময়ে ফরাসী যুবতী ভ্যালেরীর সাথে তার পরিচয় ও প্রেম হয়।নিজের টিকে থাকার স্বার্থে জয়নালের সেটার বেশ দরকার ছিল । ভ্যালেরীর মধ্যে অনেকটা এশীয় লুক ছিল। আবার মরোক্কান মেয়েদের মত লাগতো। হয়ত তার মাবাবাদের কেউ এশীয়ান বা আফ্রিকান ছিল। শ্বেতাঙ্গীনি হলেও চেহারায় কোথায় যেন একটা মিষ্টি আভা ছিল। তার সেই মিষ্টি আভাতেই প্যারিস শহরে যেন সূর্য উঠত, মেঘ কেটে যেত জয়নালের জীবনের।
দেখা হলেই হাসিমুখে বলত, বওঁজু।

ভ্যালেরী অনেক লক্ষীমন্ত একটা মেয়ে ।দুজনের মধ্যে সম্পর্কের এক পর্যায়ে দুজনে একসাথে একটা ছোট্ট ফ্লাটে থাকত। জয়নাল একটা বড় হোটেলে ম্যানেজারের কাজ করত আর ভ্যালেরীও সেখানে কাজ করত একবেলা ,আর বিকাল বেলা ব্যালে শিখত। তার খুব ইচ্ছা ছিল সে মূঁল্যা রুজ বা লাল মিলের ( Moulin Rouge)স্টেজে নাচবে।

বছর খানেক প্রেমের পর থেকেই ওরা একসাথে ফ্লাটে থাকা শুরু করে। দারুন আনন্দে কেটে যাচ্ছিল। সপ্তাহান্তে দুজনে ঘুরতে যায়। কোন কোন ছুটির দিন ভ্যালেরী নাচ শিখতে যায় আর জয়নাল ওভার টিয়াম শেষ করে মুল্যা রুজের সামনে বসে থাকে ভ্যালেরীর জন্য।আরো বছরখানেক যাবার পর শেষের দিকে ভ্যালেরী মুখ কালো করে জানায় ও কনসিভ করেছে ।ঠিক ঐ সময় বাচ্চা নেবার প্লান কারোরই ছিলনা । তাছাড়া নিয়মমাফিক বিয়েও হয়নি তখনো। কিঞ্চিত অনাকাঙ্খিত ছিল বলেই জয়নাল মন খারাপ করে । আবার তখনও নিজে সেটল হতে পারেনি। তাই ভ্যালেরীকে অনুরোধ করে বলে এবরশন করতে। রাজি হয়না ভ্যালেরী ।এটা তার ভালবাসার ফসল। তাছাড়া প্রতিটা নারীই চায় মাতৃত্বের অনুভূতি। এ তো জগত সেরা অনুভূতি।

এবরেশন করা হবে কি হবেনা এসব নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ ,মান অভিমান চলতেই থাকে। সেটা ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে। জয়নাল বুঝে উঠতে পারেনা , ভ্যালেরী ফরাসী একটা মেয়ে। সেও সন্তানের জন্য এমন আকুলিবিকুলী করবে! একদিন ঝগড়ার এক পর্যায়ে অভিমান করে ভ্যালেরী ওকে ছেড়ে পিগালী এলাকায় ওর এক বান্ধবীর এপার্টমেন্টে চলে আসে । জয়নাল দুইদিন গিয়ে খুঁজছে পাইনি। ভ্যালেরী কি করে জানি টের পেয়েছিল যে জয়নাল বাচ্চা চাইছে না ।তাই মনে হয় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। মাসখানেক ধরে খুব খুজেও ভ্যালেরীকে না পেয়ে জয়নালের সব কিছু কেমন খাপছাড়াভাবে চলতে লাগল।

প্যারিসে বেড়াতে আসা বাংলাদেশের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সাথে তার হটাৎ পরিচয় হয় এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দারুন একটা সুসম্পর্ক হয় একটা ক্যাফে বসে । সেই নেতা তাকে অনেক সময় দেয় জয়নাল। জয়নাল তাকে আকন্ঠ পান করায় , নিজে করে । তাপর সেইই রাজনৈতিক নেতা, বলে,

‘ আরেহব্বাই , দেশে চলেন , আপনাকে আমার ভাল লাগছে ।দেশে গিয়া দুইজনে একটা ব্যবসার লাইন ধরি। যত যাইই বলি বিদেশের মাটিতে থাকতে ভাল লাগবো না।কদিন পর দেশে ফিরতেই হবে। দেশে আমি সব ব্যবস্থা করব, আপনি চালাবেন ব্যবসা আর আমি দেখব রাজনীতি।’

দ্বিধায় পড়ে জয়নাল। সাহস করে আবার প্যারিসের বিখ্যাত পিগালী এলাকায় যায়। আবার গিয়ে ভ্যালেরীর খোঁজ করে ।

পিগালী এলাকাটা ফ্রান্সের মধ্যে একটূ অন্যরকম একটা জায়গা।রেডলাইট এরিয়া।
সেখানে সারারাত ক্যাবারে নৃত্য, যৌনতা ,পতিতাবৃত্তি, হৈ হুল্লা, ক্যাফেতে আড্ডা ,নেশা সব চলে এই এলাকায়। অনেকটা থাইল্যান্ডের পাতায়া বা আমেরিকার লাসভেগাসের মত। এই এলাকার সবচে বড় ল্যান্ডমার্ক হল , মুলা রুজ ( moulin rouge) বাংলায় যাকে বলে ‘লাল মিল’ যেখানে প্রতিরাতে স্টেজ শো হয় অপেরা স্টাইলে। টুরিস্টদের আকর্ষনের জন্য অনেক কিছুই শিথিল এখানে ।
উদ্দাম যৌনতায় , নেশায় ভাসতে থাকা এই এলাকায় তবুও অনেক খোঁজাখুঁজির পর জয়নাল খুঁজে পায় ভ্যালেরীকে । কিন্ত ভ্যালেরীর অভিমান ভাঙ্গাতে পারেনা। ঠান্ডা মেয়ে একবার ক্ষেপে গেলে তাকে শান্ত করতে সময় লাগে। জয়নাল চেয়েছিল যে ভ্যালেরী যদি তার সাথে ফিরে আসে তাহলে আর দেশে ফিরে যাবেনা ।

সেদিন সারাদিন পিগালীতে ভ্যালেরীর এপার্টমেন্টের সামনে বসে থেকে মান না ভাংগাতে পেরে জয়নাল সিদ্ধান্ত নেয় যে এ দেশেই আর সে থাকবেনা ।
উপরন্ত তার ঝোলায় রাজনৈতিক নেতার অমন একটা অফার।
ধীরে ধীরে সব কিছু গোছাতে থাকে জয়নাল। দিন বিশেকের মধ্যেই মন খারাপ করে দেশের ফ্লাইট ধরে ।
তিন চার বছরে প্রায় লাখ পনের টাকা জমিয়েছিল সে । তাই নিয়েই দেশে চলে আসে ।

এসেই সেই প্রভাবশালী নেতার সাথে শুরু হয় তার ব্যবসা । এবার গল্পটা সাফল্যের। প্রথমে শুরু করে গার্মেন্টসের ব্যবসা।
তরতর করে সাফল্য আসে । অবধারিত নিয়ম হিসাবে নেতা তার শর্ত ভুলে যায়, একাই ফায়দা নিতে চায়। টাকা পয়সার হিসাব দেয়না তাই দুই বছরের মাথায় সম্পর্ক ভেঙ্গে ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে যায় সে। আবার নিজে সংগ্রাম করে দাঁড়িয়ে যায় জয়নাল। নেতা ব্যবসায়িক মূলধন নিয়ে গেলেও লোকজনের সাথে পরিচয়, সুসম্পর্ক সাথে নিয়ে যেতে পারে।