আমার মনটা পড়ে থাকলো সেই কিশোরগঞ্জের হাওরে

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজনীতি সারাদেশ

ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়ক উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী

 

এম. এ. স্বপন : সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওরের রূপ দেখতে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক দেখতে যেতে নিজের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনটা পড়ে থাকলো সেই কিশোরগঞ্জের হাওরের সড়কে। বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাওরের বিস্ময় এ সড়কটির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধন ঘোষণার পর ভিডিওতে হাওরের বিস্ময় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়কের ভিডিও চিত্র দেখানো হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মনটা পড়ে থাকলো। এ সড়ক দিয়ে গাড়িতে কবে যাবো। রাষ্ট্রপতিও চান আমি যেন সরাসরি যাই। আমি যাবো। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে এ সড়ক দেখতে যাবো। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। এরইমধ্যে হাওরের নৈসর্গিক রূপ দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ছুটে আসছে মানুষ।
হাওরের বিশাল জলরাশির বুক চিরে চলে গেছে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি। বর্ষায় সড়কের দু’পাশে অথৈ জলরাশি, নির্মল বাতাস আর মনকাড়া ঢেউ। শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, যেখানে সবুজ আর সোনালি রং মিলেমিশে একাকার। হাওরের বুকে বিশাল খোলা আকাশের রূপে মুগ্ধ ভ্রমণপিপাসুরা। কখনো ঝকঝকে নীল আকাশ, কখনো আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। ভোরের সূর্য আর গোধূলীতে ভিন্ন রূপে সাজে হাওরের আকাশ।
বর্ষায় মাইলের পর মাইল বিস্তির্ণ জলরাশি, বর্ষা শেষে জলকাদা আর শুকনো মৌসুমে ফসলি জমি। বর্ষায় নৌকা আর অন্য ঋতুতে পায়ে হাঁটা ছাড়া চলাচলের উপায় ছিল না হাওরবাসীর। যোগাযোগে এখানকার মানুষের কষ্ট লাঘবে বিশাল হাওরের মধ্যে সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কিশোরগঞ্জ জেলার তিন উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের জন্য নির্মিত হয় হাওরের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক। সড়কটি নির্মাণের ফলে শুধু হাওরবাসীর চলাচলের দুর্ভোগ দূর হয়েছে তা নয়, নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে।
২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি নির্মাণ করেছে।
হাওরের বুক চিরে চলে যাওয়া ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু ও ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, দৃষ্টিনন্দন নতুন সড়কটি নির্মিত হয়েছে জলে ভাসা কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে। এতে নতুনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে হাওরের প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে। দূরের বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট গ্রাম যেন একেকটি ভেসে থাকা দ্বীপ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমিতে পর্যটন আকর্ষণের নতুন সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে হাওরবাসীর স্বপ্নে।
ভরা বর্ষায় এখানকার মানুষের চলাচলে একমাত্র ভরসা ছিল নৌকা। আর এখন হাওরের বিস্ময় খ্যাত এই সড়কে চলে নানা ধরনের যানবাহন। উত্তাল ঢেউ আর এলোমেলো বাতাসে খানিকটা পথ মাড়ালেই মিলবে নৈসর্গিক তৃপ্তি। বিচ্ছিন্ন এসব এলাকার মানুষ এখন পাকা সড়ক ধরেই গন্তব্যে ছুটছেন।
দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের মাঝখান দিয়ে পিচঢালা প্রশস্ত উঁচু সড়ক। দুই পাশে উত্তাল ঢেউওয়ের গর্জন। সড়কে সাঁই সাইঁ করে চলছে ছোট ছোট যানবাহন। দূর থেকে মনে হবে যেনো যেতে যেতে পাকা রাস্তা মিশে গেছে জলের বুকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি জীববৈচিত্রের এক অপরূপ এলাকা কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল। আর হাওরের সৌন্দর্য যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এ সড়কটি।
এক সময়ের অবহেলিত হাওর জনপদ জেলার ইটনা-মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে এ অলওয়েদার সড়ক। সড়কটি হাওরবাসীর কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘হাওরের বিষ্ময়’ কিংবা ‘স্বপ্নের সড়ক’ নামে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় কর্মসংস্থান বেড়েছে শ্রমজীবী মানুষের। হাওরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। গত অর্থ বছরে ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘অল ওয়েদার সড়ক’ নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। সড়ক ও জনপথ বিভাগ নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাসেদুল আলম বলেন, এই সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
ভবিষ্যতে এ সড়কটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পর্যন্ত বর্ধিত করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে বলে জানান, এলাকার সংসদ সদস্য। কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেন, সড়কটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর পর্যন্ত বর্ধিত হয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। শুকনো মৌসুমে জেলা সদরসহ সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় আরও ৪শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ৩৬ কিলোমিটার সাব-মার্সেবল সড়ক। যানবাহন পারাপারে ধনু ও বাওলাই নদীতে বসানো হয়েছে ৫টি ফেরি।
এলাকাবাসী জানিয়েছে, এ সড়ক উদ্বোধনের মাধ্যমে হাওরে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে। সড়ক ঘিরে হাওরে, কেরালার মডেলে পর্যটন এলাকা ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। হাওরবাসীর অলওয়েদার সড়ক উদ্বোধন হলে দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের মাঝ দিয়ে পিচঢালা প্রশ্বস্ত উঁচু সড়কটি ঘিরে সমৃদ্ধ হবে হাওরের অর্থনীতি। বাড়বে মানুষের জীবনমান এমনটা মনে করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাওরের অপরূপ সৌন্দর্যের ছবি চোখে পড়ে। এসব দেখে সুইডেন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা অন্য কোনো দেশের মনে হলেও আদতে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল। এসব ছবি দেখে করোনাভাইরাস মহামারিতেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভ্রমণপিপাসুরা ঘুরতে আসেন। সাগরের মতোই হাওরে সূর্য ডোবে। ভোরে পানির নিচ থেকে উঠে আসা সূর্যকে দেখলে মনে জাগে অন্যরকম অনুভূতি। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় সৃষ্টি হয় চমৎকার সৌন্দর্য।
মিঠামইনের ইউএনও প্রভাংশু সোম মহান বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই হাওরের সৌন্দর্য নয়নাভিরাম। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সারা বছর চলাচল উপযোগী অল ওয়েদার রোড। সড়কটির ফলে এই এলাকা জুড়ে এখন পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা। হাওরের উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে তার ছেলের মাধ্যমেই। তাই তো হাওরবাসীর স্বপ্নপূরণের বিস্ময়কর সড়ক ভ্রমণে চালকের আসনে ছিলেন তার ছেলে তৌফিক।
প্রসঙ্গত, ছোট ভাই ও সহকারী একান্ত সচিব মো. আবদুল হাইয়ের মরদেহ নিয়ে মিঠামইনে নিজের বাড়িতে যান রাষ্ট্রপতি। ভাইয়ের জানাজা শেষে পরদিন ঢাকায় ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও হাওরের নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়ন নিজ চোখে দেখতে আরো দু’দিন অপেক্ষা করেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওর বর্ষায় থৈ থৈ জলের মাঝখান দিয়ে প্রশস্ত মসৃন পাকা সড়কে হাঁকিয়ে চলবে মোটরযান। যেতে যেতে রাস্তার দু’ধারে শোনা যাবে উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন। কচুরিপানার মতো ভাসতে থাকা গ্রামগুলোর পেছনে দিগন্তে নুয়ে পড়া নীলাকাশ ডাকবে হাতছানিতে।


বিজ্ঞাপন