বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে বাড়ি-গাড়ি-ভবন নির্মাণে অনিয়ম

অপরাধ এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন রাজধানী

বিশেষ প্রতিবেদক : অবৈধভাবে শ্রমিক নিয়োগবিজ্ঞানীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও প্রকল্পের অর্থের অপচয়সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) ড. মো. শাহজাহান কবীরের বিরুদ্ধে। বাড়ি, গাড়ি, ফটক ও নতুন ভবন নির্মাণেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে আসছেন বলেও জানিয়েছেন ব্রি’র কর্মকর্তারা। আর এসব বিষয়ে জানতে কৃষি মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিতেও ডাক পড়েছে তার। বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) তাকে মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল।
ড. শাহজাহান কবীরের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আসে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে কৃষি মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে। গেল ১ অক্টোবর ওই কমিটির পাঠানো এক চিঠিতে ড. মো. শাহজাহান কবীরকে তলব করা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠিতে বলা হয়, দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের বিষয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিবের (পিপিসি) সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শাহজাহান কবীরের বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার তাকে ডাকা হয়েছিল। ড. শাহজাহান এদিন মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়েছিলেন। তবে তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় এদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব (পিপিসি) ড. মো. আবদুর রৌফ বলেন, ‘উনাকে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার আমরা কৃষিমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত ছিলাম। এছাড়া তদন্ত কমিটির একজন অনুপস্থিত ছিলেন। তাই তাকে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। পরবর্তী সময়ে আমরা আবারও বসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের তারিখ নির্ধারণ করব।’
তিনি বলেন, ‘উনার বিরুদ্ধে ব্রিতে কনস্ট্রাকশনের কাজ, গেইট নির্মাণ, উনার বাসার অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক ও গুরুতর অভিযোগ মন্ত্রণালয়ে এলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এক্ষেত্রেও মন্ত্রণালয় মনে করেছে, কমিটি করা দরকার। সেই কমটিতে আমার সঙ্গে আরও দুজন রয়েছেন। কমিটির পক্ষ থেকে উনাকে তলব করা হয়েছে।’
এদিকে অভিযোগের বিষয়ে ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি পাঠানো হয়েছে তা উড়ো চিঠি। তিনি কোনো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। অভিযোগের বিষয়ে জবাব দিতে বৃহস্পতিবার তিনি মন্ত্রণালয়ে হাজির হয়েছিলেন।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ড. শাহজাহান কবীরকে ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট ব্রি’র মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর থেকে তার বিরুদ্ধে অনুমোদনহীনভাবে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ, পদোন্নতি ও বাসা বরাদ্দে অনিয়ম, পরিচালকের বাংলোর জন্য বরাদ্দ টাকায় মহাপরিচালকের জন্য বিলাসবহুল বাংলো নির্মাণ, এক বছরের ব্যবধানে নিজের জন্য কোটি টাকার দুটি গাড়ি ক্রয়, জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের নামে প্রায় ১০ কোটি টাকা লুটপাট, বিজ্ঞানীসহ অধীনস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের নানা অভিযোগ ওঠে।
এছাড়া মহাপরিচালের দায়িত্ব পাওয়ার আগেই ২০১৩ সালে তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের দিয়ে ব্রি’র বিজ্ঞানীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে এই ঘটনায় তাকে মূল পরিকল্পনাকারী ও ইন্ধনদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে। ওই সময় তিনি ব্রি’র পরিসংখ্যান বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের লাঞ্ছনার ঘটনায় সম্পৃক্ততা প্রমাণ হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো পরের বছরই তিনি পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা) পদে দায়িত্ব পান।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ব্রি’তে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে ড. শাহজাহান কবিরের বিরুদ্ধে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক পত্র থেকে জানা গেছে, ব্রি’তে ৬৭১ জন শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন চেয়ে ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর সচিবকে একটি চিঠি দেন মহাপরিচালক। জবাবে মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া ব্রিতে অতিরিক্ত ২৯৮ জন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই সময় অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি শ্রমিক নিয়োজিত থাকার পরও নতুন করে শ্রমিক নিয়োগের অনুমোদন চাওয়ার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। কিন্তু এর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেয়ে চলতি বছরের ৭ জুন কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ব্রি’র মহাপরিচালককে দেওয়া আরেকটি চিঠিতে বলা হয়, ‘মন্ত্রনালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া শ্রমিক নিয়োগ একটি অনিয়ম বা বিধি-বিধানের পরিপন্থী’।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা অনুসারে, ব্রি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে শ্রমিক নিয়োগ করার কথা। এ কমিটির আহ্বায়ক হলেন পরিচালক প্রশাসন এবং সদস্য সচিব হলেন খামার ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান। অথচ ব্রি’র মহাপরিচালক এ কমিটিকে উপেক্ষা করে কমিটির সদস্য নন এমন একজন সহকারী পরিচালকের মাধ্যমে গত জানুয়ারিতে অতিরিক্ত শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্রি’তে একটি রাইস মিউজিয়াম স্থাপন কর্মসূচির পরিচালক হিসেবে সিনিয়র লিয়াজোঁ অফিসার মোহাম্মদ আব্দুল মোমিনকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ২৭ মে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠান শাহজাহান কবীর। মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অনুমোদনও করা হয়। কিন্তু ওই সময় আব্দুল মোমিন উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রেষণে ছিলেন। যা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া প্রস্তাবে গোপন রাখা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ২৪ জুন কৃষি মন্ত্রনালয় এক চিঠিতে ব্রির ডিজির বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ আনে। চিঠিতে বলা হয়, ‘প্রেষণ ভোগরত কোনো কর্মকর্তাকে কোনো কর্মসূচির পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ কিন্তু ওই লিয়াঁজো অফিসারকে এখনও কর্মসূচি পরিচালকের এই দায়িত্বে বহাল রাখা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত তার প্রেষণ শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।
২০১৬ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস ব্রি’র মেইন গেইট সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এজন্য সদ্য প্রয়াত ভাস্কর মৃণাল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ৫০ লাখ টাকা দিয়ে তখন প্রধান ফটক নির্মাণ করা হয়। ড. শাজাহান কবীর ওই সময় পরিচালক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মৃণাল হককে বাদ দিয়ে তার পছন্দের কাউকে দিয়ে কাজটি করাতে চেয়েছিলেন। পরে ২০১৭ সালে শাহজাহান কবীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে ওই ফটকটি ভেঙে ফেলে প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ফটক নির্মাণ শুরু করে। নির্মাণ কাজ এখনও চলছে। ব্রি’র কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলেছে, প্রধান ফটক এক বছরের মাথায় দুবার ভাঙা হয়। প্রথমবারর স্থপতি মৃণাল হককে দিয়ে ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হয়। দ্বিতীয়বার স্থপিত মৃণাল হককে বাদ দিয়ে ৫৫ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে।
ব্রি’র পরিচালক (প্রশাসন) ও মহাপরিচালকের বাংলো আগে থেকে ছিল। শুধুমাত্র পরিচালকের (গবেষণা) বাংলো নতুন করে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি না করে মহাপরিচালকের বাংলো ভেঙে নতুন করে দুই কোটি টাকায় মহাপরিচালকের বাংলো বানানো হচ্ছে। এর আগে ব্রি’র মহাপরিচালকের বাংলো ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় সংস্কার করা হয়। ফলে বাংলো নির্মাণে সরকারের দুই কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে বলে ব্রি’র কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। এছাড়া ব্রি’ উচ্চ বিদ্যালয়ে টেন্ডার ছাড়া বিল্ডিং নির্মাণ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
করেনাকালীন রাষ্ট্রের টাকা অপচয় করে ব্রি’র স্পাইরো প্রকল্প হতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার গাড়ি (গাজীপুর-ঘ ১১-০০৭৭) কেনার অভিযোগ রয়েছে ব্রি’র মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে। এছাড়াও জিওবি হতে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা দিয়ে আরেকটি ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি (ঢাকা-ঘ১৮-৭০১৪) কেনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। করোনার সময় প্রধানমন্ত্রী নতুন করে সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি না কেনার নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে প্রধামন্ত্রীর নির্দেশনাও উপেক্ষা হয়েছে বলে ব্রি’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ব্রি’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) বর্তমানে প্রায় ২৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের লবিং ও মহাপরিচালকের আস্থাভাজনেরা এসব প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন। এর ফলে ক্ষুব্ধ রয়েছে ব্রি’র একটি পক্ষ। এছাড়া মহাপরিচালকের চাকরির মেয়াদ প্রায় তিন বছর পূর্ণ হতে চলছে। এতে একটি অংশ পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে ক্ষুব্ধ রয়েছেন তারাও। পদোন্নতি বিষয়ে সদ্য প্রয়াত ধান বিজ্ঞানী ড. তমাল লতা আদিত্যও ক্ষুব্ধ ছিলেন। পদোন্নতি না পাওয়া নিয়ে তিনি হতাশায় ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন ব্রি’র একজন কর্মকর্তা।


বিজ্ঞাপন