চবি’র কাজেও জিকে শামীমের থাবা

চট্টগ্রাম শিক্ষাঙ্গন

কোন রকম যোগ্যতা ছাড়াই ৭৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ!

 

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি : যোগ্যতাই নেই। নেই ন্যূনতম অভিজ্ঞতাও। তবুও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণের কাজ পেতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি আলোচিত জি. কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বি এন্ড কোম্পানির। মূলত জাল কাগজ তৈরি এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এবং প্রভাব খাটিয়ে ৭৫ কোটি টাকার কাজটি ভাগিয়ে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। মূলত দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকে কাজ পাইয়ে দিতে এমন জালিয়াতির ফন্দি আটেন প্রভাবশালী এ ঠিকাদার। এমন অনৈতিক কাজ জায়েজ করে দিতে নমনীয় ছিল স্বয়ং দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিও। দুদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে পাওয়া যায় এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ ঘটনায় জি কে শামীম ও তার সহযোগী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. ফজলুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।


বিজ্ঞাপন

গতকাল (রবিবার) বিকেলে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এ মামলা দায়ের করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় জি কে বি এন্ড কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়া শামীম এবং দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল করিম চৌধুরীকে আসামি করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ এর উপ-পরিচালক লুৎফুল কবীর চন্দন সাংবাদিকদের বলেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ভবন নির্মাণের কাজ নেন দুই ঠিকাদার। অনুসন্ধানে এর সত্যতা পাওয়ায় প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার মামলা নম্বর-২।’

দুদক বলছে, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অযোগ্যতা আর অদক্ষতার সুযোগে এমন জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কাজটি ভাগিয়ে নেয়া হয়। যার জন্য কমিটিতে থাকা সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সুপারিশ করা হয় বলে দুদকের বিশ্বস্ত সূত্র পূর্বকোণকে নিশ্চিত করেন।

তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ একাডেমিক ভবনের ২য় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজ বাস্তবায়নে দরপত্র আহ্বান করা হয়। যা সর্বনিম্ম দরদাতা হিসেবে একই বছরের ১৪ নভেম্বর ৭৫ কোটি একলাখ ২৯৫ টাকায় দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স ও জি কে বি এল (জেবি) কে কার্যাদেশ দেন এবং তাদের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করেন কর্তৃপক্ষ।

দুদক বলছে, দরপত্র মূল্যায়নকালে টেন্ডার বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠান পাঁচবছরে কমপক্ষে একটি ৩৫ লাখ টাকার বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ সন্তোষজনকভাবে সমাপ্তির সনদপত্র, ৪১ কোটি টাকার টার্নওভার এবং ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকার লিকুইড এসেটসহ ব্যাংক হতে মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান পত্রের মাধ্যমে যাচাই করে সঠিক প্রাপ্ত হয়ে সকল প্রক্রিয়া শেষে এ কার্যাদেশ প্রদান করেন। অথচ আলোচ্য টেন্ডার নোটিশের ১৯ (ডি), ১৯ (ই) ও ১৯ (এফ) তে উল্লেখিত শর্তপূরণ করার মত নির্মাণ কাজের যোগ্যতা না থাকা সত্বেও তাদের কাজ পাইয়ে দেয় কমিটি। মূলত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্যগণের অযোগ্যতা ও অদক্ষতার সুযোগে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রভাবিত করে কার্যাদেশ হাসিল করেন এ দুই ঠিকাদার। ২০১৮ সালে এ সংক্রান্ত বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। এরপর গেল দুই বছর দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ পায় দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যার কারণে দুই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা ও কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এদিকে, নির্মানাধীণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচ্য এ ভবনের কাজের মেয়াদ শেষ হওয়ায় অন্তত চার বার মেয়াদ বাড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবুও শেষ হয়নি এ কাজ। গেল চার বছরে মাত্র ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কাজের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে গত রবিবার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীন আখতারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে কোন কথা বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি কল সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এসব প্রসঙ্গে আলোচনা করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি এডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র জায়গা তথা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন কমিটি অবৈধ প্রতিষ্ঠানকে এমন কাজে অনুমোদন দেয়া নিঃসন্দেহে দায়িত্বের অবহেলা। অথবা তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন নি। কিংবা নিজেরাই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। যদি এমন হয়, অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনা দরকার। একই সাথে যে যতটুকু অপরাধ করেছে, তাকে ততটুকু শাস্তির আওতায় আনা দরকার। না হলে ভবিষতে একই ঘটনা বারবার হবে’।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর কেন্দ্রীয় যুবলীগের সমবায় সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দেওয়া জি কে শামীমকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। মো. গোলাম কিবরিয়া (জি কে) শামীম ঢাকার জি কে বি এন্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এছাড়া অভিযুক্ত দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল করিম চৌধুরী কেন্দ্রীয় যুবদলের সদস্য। তার গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার সদর থানাধীন নৈরাজপুর গ্রামে।