একজন নির্লোভ মানুষের গল্প

অন্যান্য বিবিধ সাহিত্য

মোস্তাফিজুর রহমান : অন্যের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য যারা নেপথ্যে থেকে হাড়ভাংগা পরিশ্রম করে, তারা কখনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়না, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার জন্য মানুষও খুজে পাওয়া যায়না। অথচ নেপথ্যে থাকা মানুষগুলোই সকল সফল মানুষগুলোর সফলতার প্রকৃত অংশীদার। শিল্পীর রং-তুলির আন্তরিক আচড়ে প্রতিটি শিল্পকর্ম চমৎকার রূপায়ন ফিরে পায়, শিল্পকর্মটির প্রতি মানুষের ভালবাসা আর ভাললাগার প্রকাশগুলি সৃষ্টি জুড়েই সীমাবদ্ধ অথচ বেশীরভাগ মানুষ এটার স্রষ্টার খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা।
সময় ও ভাগ্যের পরিবর্তন হলে কে কাকে মনে রাখে! উপকারীর কথা মনে রাখা লোকের সংখ্যা নেহাৎ কম। আমার জীবনে দুমুঠো ডালভাতের জাগিতিক নিশ্চয়তার টার্নিং পয়েন্টে যারা সোপানে আরোহন করার জন্য অনুপ্রেরণার রসদ দিয়ে নীরবে সাহায্য করেছে তাদের মধ্যে বুলবুল নামক একজন ব্যক্তির নিকট আমি চিরকৃতজ্ঞ ও ঋনী।


বিজ্ঞাপন

জনাব বুলবুল মোল্যা আমার জন্মস্থান গোপালগঞ্জেরই সন্তান এবং একই ইউনিয়নের বাসিন্দা। পেশায় গার্মেন্টসের টেকনিক্যাল কর্মী। আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে তিনি ১৫০০০ টাকা মাসিক বেতন পেতেন। বাড়ীতে অভাব অনটন থাকায় নিজ খোরাকির টাকা রেখে বাকী টাকাগুলো বাবাকে পাঠাতে বাধ্য হতেন। আমি ছাত্র মানুষ ও চাকুরী প্রত্যাশী, ওনাদের সাথেই চট্টগ্রাম শহরে মেসে থাকি। মেসে প্রতিদিন বাজারের জন্য মাথাপিছু টাকা তুলা হতো।

আমিতো তখন বেকার,এবং প্রকৃত অভাবী। নামমাত্র টিউশনি করি, মাস শেষে বেতন বিধায় প্রতিদিন নগদ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার ছিলোনা। যে সকল রুমমেটদের অর্থের প্রতুলতা আছে, মাস শেষে দেওয়ার শর্তে তারা কেউই আমার পক্ষে মেসের খরচ চালাতে রাজী নয়। চরম সংকটাবস্থায় জনাব বুলবুল আমার পক্ষে দৈনিক মেসের খরচ চালাবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু তিনিও অভাবী। যাই হোক তিনি বিকেল পাচটায় প্রতিদিন অফিস থেকে এসে গোপনে ( মুখে গামছা বেধে) রিক্সা চালাতেন শুধুমাত্র আমার খোরাকির টাকা জোগাড় করার জন্য,যে ঘটানা আমি এক বছর পর উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। সেদিন আমি তার সামাজিক সম্মানবোধ ও আত্নত্যাগের কথা ভেবে লজ্জায় নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং তাকে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কান্না করেছিলাম অনেকক্ষণ।

দুইযুগ আগে ১৫০০০ টাকা বেতন পাওয়া মানুষটির সাংসারিক পিছটান থাকায় নিজে অভাব অনটনে দিনতিপাত করলেও সামাজিক মর্যাদা কিন্তু মোটেই কম ছিলোনা। কতটা মানবিক মানুষ হলে নিজ সম্মানবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে মুখ পরিচয়ের সূত্রে আমার জন্য সাবস্ট্যান্ডার্ড কর্মে নিয়োজিত হতে পারে, তা আজও আমাকে ভাবিয়ে তুলে। আমি তার থেকেই মানবতার হাতে খড়ি নিয়েছি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষটার অর্থের প্রতুলতা না থাকলেও অন্যের জন্য আত্নত্যাগের যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা থেকেই আমি মানবিক শিক্ষা নিয়েছি যে, শিক্ষা ও অর্থ থাকলেই মানবিক হওয়া যায়না। মানবিক মানুষ হতে হলে অন্যের প্রতি ভালবাসার অনুধাবন শক্তি থাকাটাই মুখ্য বিষয়।

তিনি পরবর্তীতে পরিবারের অসম্মতিতে মোসাম্মৎ তারা নামের এক মহিলা সহকর্মীকে বিবাহ করার কারণে পরিবার থেকে বিভাজন হয়ে যায় এবং গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষি কাজের ফাকে প্রতিদিন ভ্যানগাড়ি চালিয়ে অনটনের মধ্যে দিনতিপাত করতে থাকেন। বুলবুল চট্টগ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর আমার সরকারি চাকুরী হয়। আমার সহোদররা একেএকে শিক্ষাজীবন শেষ করে কেউ পরিবার নিয়ে আমেরিকা, কেউ বাংলাদেশে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার ও রাজনীতি পেশায় জড়িয়ে পরিবারের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে আসছে। বেড়েছে সামাজিক যশ, খ্যাতি ও সক্ষমতা কিন্তু বুলবুল জীবনের সাথে যুদ্ধ করে আজও দিনতিপাত করে যাচ্ছে।

ক্ষুধার্ত মানুষ হিসেবে বিলাসিতার সুযোগ না থাকলেও স্ত্রী ছেলে মেয়ে নিয়ে আমারও দুমুঠো ডালভাত খাওয়ার সুযোগ হয়েছে কিন্তু বুকবুল আজও দৈন্যতার সাথে নিয়মিত যুদ্ধ করে নামকাওয়াস্তে বেচে আছে। প্রতিবছর তিনবার বাড়ীতে যাওয়া হয়, স্ত্রী সন্তান নিয়ে প্রতিবার তার বাড়ীতে গিয়ে কুশল বিনিময় করি। জরাজীর্ণ ঘরে বসেই সে সাধ্যমতো আপ্যায়ন করে প্রতিবার । ফরমালিন মুক্ত গাছের ফলফলাদি দিয়ে আন্তরিক আপ্যায়ন গ্রহণ করি মুক্তমনে।

আমার প্রতি বুলবুলের আত্নত্যাগের কথা আমার পরিবারের সকলেই ভালভাবে ওয়াকিবহাল। বুলবুলের মানবেতর জীবন যাপন থেকে উত্তরণের জন্য আমার সামর্থ্যবান সহোদরেরা এবং আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আমার শ্রদ্ধেয় মা নিজেও বলেছে তার প্রয়োজনীয় কিছু নেওয়ার জন্য কিন্তু কোনভাবেই বুকবুলকে রাজী করানো সম্ভব হয়নি। নির্লোভ ও নিঃস্বার্থ মানুষেরা এমনই হয়। আমার সন্তানেরাও তার জন্য কিছু একটা করতে উদগ্রীব কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল। অনেকের ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারলেও বুলবুলের ভালবাসা আর ঋণের বোঝা নিয়েই হয়তো আমাকে ওপারে যেতে হবে।

প্রতিটি ঘরে এমন বুলবুল জন্মায় না। লোভের উর্ধে থাকা অভাবগ্রস্থ এই মানুষটি আমার জীবনে আদর্শের এক বাতিঘর, যে আলোয় আলোকিত হয়ে আমাদের পুরো পরিবারের সকল সদস্যকে বুলবুলের আদলে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। বুলবুল আমার সমবয়সী হলেও তার মহান কর্মযজ্ঞ ও নির্লোভ মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই অবিরত। শিক্ষিত, মার্জিত, বিত্তশালী ও মনিষীরা সকলের কাছে আইডল হয় কিন্তু অক্ষরজ্ঞানহীন বুলবুল আমার কাছেই একমাত্র আইডল, যার থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের ভালবাসায় আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা মুগ্ধ।

নির্লোভ, নিরহংকারী ও পরোপকারী বুলবুলের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।অশেষ কৃতজ্ঞতা বুলবুলের প্রতি।
বাংলার প্রতিটি ঘরে যেন একেকজন বুলবুলের জন্ম হয়, যার দ্বারা প্রতিমুহূর্তে মানুষের জীবন ও সমাজ বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।