১৫ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক বাথুলী যুদ্ধ ও শহীদ আ. ওহাবের শাহাদাত বরণ

অন্যান্য বিবিধ

বীর মুক্তিযোদ্ধা আজহারুল ইসলাম আরজু : ১৪ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত মানিকগঞ্জ শহরে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সবার আগে মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রন নেয়ার পর আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি। ঐদিন রাতেই আমরা বারাহিরচর নূর মোহাম্মদ মোল্লার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করি। ১৫ ডিসেম্বর সকালেই খবর আসে পশ্চিম দিক থেকে পাক বাহিনী ঢাকার দিকে পালিয়ে মানিকগঞ্জ ক্রস করছে। একদল ঢাকা-আরিচা রোড ধরে অন্য দল গ্ৰামাঞ্চল দিয়ে বালিরটেক হয়ে ঢাকার দিকে ছুটে আসছে। আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো বাহিনীকে এ বি সি তিন ভাগে ‌বিভক্ত করে তিন জন কমান্ডার এর অধীনে অপারেশন প্ল্যান করা হয়। এ গ্ৰুপ যুদ্ধ শুরু করলে বি ও সি গ্ৰুপ ডান দিকে স্ট্যান্ড বাই থাকবে, শত্রুরা এ গ্ৰুপ অতিক্রম করে বি গ্ৰুপের রেঞ্জে ঢুকলে বি গ্ৰুপ ফায়ারিং শুরু করবে,এ গ্ৰুপ নতুন করে সি গ্ৰুপের ডান দিকে পজিশন নিবে, এভাবে পজিশন শিফ্ট করে শত্রুর বিনাশের পর্যায়ক্রমিক আক্র মন চলতে থাকবে।
প্ল্যান মতো আমরা বারবারিয়া ব্রীজের পূর্ব পাশে বাথুলী পর্যন্ত পুরো বাহিনী পজিশন নিই। নির্দেশ ছিল সোনামুদ্দিন ভাই স্টেন গান ফায়ার করে আক্রমন শুরু করবে। আমি ছিলাম এ গ্ৰুপে। রাইফেল শত্রুর দিকে তাক করে ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে অপেক্ষা করছি গুলিতে পাক হানাদারের বুক ঝাঝড়া করে দিতে। হাত পা নিসপিস করছে। শত্রুরা এক পা দু পা করে রাস্তার নীচ দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাঙ্খিত স্টেন গানের ব্রাশ ফায়ার হচ্ছে না ট্রিগারেও চাপ দিতে পারছিনা। শত্রুর চেহারা দেখে আর থাকতে পারলাম না চারদিক থেকে এক সাথে গুলি শুরু হয়ে গেল, গুলিতে হানাদার বাহিনীর বুক ঝাঝড়া হয়ে ইয়া আলী আওয়াজ তুলে লাফিয়ে উঠলো। শুরু হলো মরনপন লড়াই। আমাদের একটা মাত্র এল এম জি, দুটো স্টেন, তিন টা এসএলআর আর সব থ্রীনটথ্রী রাইফেল। অন্যদিকে শত্রুর হাতে সব অটোমেটিক রাইফেল,ভারী অস্ত্র। মুহুর্মুহু ব্রাশ ফায়ার আর গুলিতে চারিদিকে শুধু ঠা ঠা শব্দ, আমাদের দিক থেকে জয় বাংলার ধ্বনী। পরিকল্পনা মতো পজিশন শিফ্ট করে শত্রুর সাথে মরনপন লড়াই চলতে থাকে। শত্রুরা পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় আমরাও পজিশন পূর্ব দিকে এগিয়ে যাই, এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। আমরা গ্ৰাম দিয়ে দৌড়িয়ে হানাদার বাহিনীকে টার্গেটে ফেলে গুলি চালাতে থাকি। সোনা ভাই এল এম জি থেকে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। বিকেলের দিকে জফুরা ব্রীজের কাছে যাওয়ার পর পিছন থেকে খবর আসে বাথুলী বাজারের কাছে একজন মুক্তিবাহিনী গুলিতে শহীদ হয়েছে। একটু কাউন্ট করে বুঝতে পারলাম আমাদের প্রিয় ওহাব ভাই আর নেই। তখন আমরা রিট্টিট করার সিদ্ধান্ত নেই। পুরো অপারেশনে শ্রদ্ধেয় শফি মাস্টার খালি হাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দের উৎসাহ জুগিয়েছেন তা কোন তূলনা হয় না।


বিজ্ঞাপন

ফিরার পথে কালামপুর বাসস্ট্যান্ডের দক্ষিণ দিকে এক গ্ৰামের মানুষ একত্র হয়ে খাবার সংগ্রহ করে আমাদের খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু আমাদের তখন খাওয়ার সময় এবং মানসিকতা কোনটাই ছিল না, আমাদের তাড়া করছিল ওহাব ভাইর মৃত্যু সংবাদ। আমরা হাঁটতে থাকি আর গ্ৰামের মানুষ আমাদের মুখে খাবার তুলে দিতে থাকে। সে মহব্বত সে ভালোবাসার কোন তুলনা হয় না।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে বা্রাহিরচর মাঠে ওহাব ভাইর মরদেহের সামনে এসে পুরো বাহিনী কেঁদে উঠলো। যে ওহাব ভাই যুদ্ধের শুরু থেকে ক্যাপ্টেন হালিমের সাথে থেকে মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা দের ট্রেনিং দিয়েছেন, অনেক অনেক কষ্ট আর যন্ত্রনা সহ্য করেছেন তিনি শেষ সময়ে এসে পাক বাহিনীর পরাজয় এবং বাংলাদেশের বিজয় দেখে যেতে পারেননি। দেশও স্বাধীন হলো ওহাব ভাইও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
শহীদ আঃ ওহাব কে কখনো ভূলবো না।

১৫ ই ডিসেম্বর সারা দিনে পাক বাহিনীর মোকাবেলায় মানরায় শহীদ চানমিয়া,বাথুলীতে শহীদ আঃ ওহাব, সাভারে বেইলী ফার্মের কাছে টিটু শহীদ হন। এই তিনজন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মানিকগঞ্জ এর বীর সন্তান। তাদের প্রতি অতল শ্রদ্ধা।