মাদকেও ভেজাল

অপরাধ

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে অবৈধভাবে মদ তৈরির শত শত কারখানা গড়ে উঠেছে। মদ্যপায়ীর বড় অংশ এসব কারখানার নকল ও মানহীন মদের ওপর নির্ভরশীল। মাদকাসক্তরা এই ভেজাল মাদক সেবনে অভ্যস্ত। ফলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যেই মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাড়াশি অভিযানে ইয়াবা, হেরোইন ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরণের মাদক উদ্ধার হচ্ছে। আর প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবা, মদ, ফেনসিডিল ও হেরোইন ভেজাল করছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের অব্যাহত অভিযান সত্বেও মাদকের আগ্রাসী থাবা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকারি কঠোর পদক্ষেপের মধ্যেও মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণনব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে। ইদানীং বাকপ্রতিবন্ধীদের (বোবা) মাধ্যমেও পাচার হচ্ছে ইয়াবা। সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারায় ভেজাল মদের কারখানায় পুলিশের অভিযানের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ হয়। আর তারমধ্যে মদ পানে সম্প্রতি কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় উক্ত কারখানায় অভিযান চালানো হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, করোনার সময়ে ওয়ারহাউসগুলো থেকে মদ কেনায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। ফলে দেশের মাদকের বাজারে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে ভেজাল মদ তৈরিতে কারখানা করা হয়েছে। ভাটারা থানার খিলবাড়িরটেক এলাকার এক ভবনে ওই কারখানার সন্ধান পায় পুলিশ। অভিযানে মনতোষ চন্দ্র অধিকারী ও রফে আকাশ (৩৫), রেদুয়ান উল্লাহ (৩৫), সাগর বেপারী (২৭), নাসির আহমেদ রুহুল (৪৮), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) ও সৈয়দ আল আমিন (৩০) নামে ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মদসহ, মদ তৈরির নানা সরঞ্জাম, মদের পুরনো বোতলও উদ্ধার করে পুলিশ।
অভিযানের পর ডিবি’র উপ-কমিশনার মো. মশিউর রহমান জানান, ভেজাল মদ তৈরীর কারখানার মালিক নাসির আহমেদ রুহুল, ‘ম্যানেজার’ সৈয়দ আল আমিন এবং ‘চিফ কেমিস্ট’ জাহাঙ্গীর আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীরের বাড়ি চাঁদপুরে। একসময় ভাঙারি দোকানের কর্মচারী ছিলেন। বিভিন্ন প্লাস্টিক ও কাঁচের বোতল সংগ্রহ করে মিডফোর্ডে বিক্রি করতো। জাহাঙ্গীর কারখানাটিতে ভেজাল মদ তৈরি করতো। এজন্য প্রতিদিন ৫০০ টাকা পেতেন। ভাঙারি দোকানদার চড়ামূল্যে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের হাতে তুলে দিত মদ নামক বিষ। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড থেকে স্পিরিট, স্টিকার, রং সংগ্রহ করে, চিনি পোড়ানো কালার ব্যবহার করে নকল মদ তৈরি করত।
পুলিশ ওই বাড়ি থেকে নকল বিদেশি মদ, খালি মদের বোতল, মদের বোতল আটকানোর ছিপি, স্টিকার, স্পিরিট, কৃত্রিম রঙ, সিলগালার সামগ্রী উদ্ধার করেছে। ভেজাল মদ পানে এক ব্যক্তির মৃত্যুর সূত্র ধরে কারখানাটির সন্ধান পায় পুলিশ। ওই কারখানার বিষাক্ত মদপানে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ মাঠে নামে।
সূত্র জানায়, বিদেশি বিভিন্ন ব্রান্ডের বোতলে ভেজাল মদ ভরে বিক্রি করে আসছিল একটি চক্র। আর তা পান করেই সম্প্রতি মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। করোনায় মদের আমদানি বন্ধ থাকার সুযোগ নিয়েই চলছিল এ বাণিজ্য। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে খিলবাড়ীর এক কারখানায় ছয়জনকে গ্রেফতার করে। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, কাঠের কাজে যে স্পিরিট ব্যবহার করা হয় সেটার সঙ্গে প্রথমে মেশানো হয় কাপড় বা খাবারের রং। এরপর চিনির রস ও কিছু রাসায়নিক মিশিয়েই ভেজাল মদ তৈরী করা হতো। ভেজাল মদ পানে বগুড়া ও ঢাকায় মোট ১৩ জন মারা গেছেন। বগুড়ার দুটি হোমিও হল থেকে কেনা মদ পানে আটজন মারা যায়।
অপরদিকে গাজীপুরের এক রিসোর্টে ভেজাল মদ পানে পাঁচজন মারা যায়। আর তার পরই নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান শুরু করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ডা. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেছেন, ভেজাল মদে ইথানলের পরিবর্তে মিথাইল মেশানো হয়। এজন্যই বিষক্রিয়ায় মানুষ মারা যায়। ডিবির ডিসি মশিউর রহমান বলেন, নকল মদ কারবারিরা এক গ্যালন স্পিরিট দিয়ে ১০০ বোতল ‘বিদেশি মদ’ বানায়। পরে তা হোম ডেলিভারি করে।
সূত্র জানায়, ফোনে ফোনে অর্ডার নিয়ে স্পটে ভেজাল মদ পৌঁছে দিত রাজধানীর এক চক্র। বিশেষ কায়দায় মেশিন দিয়ে লাগানো হতো বোতলগুলোর ছিপি। এসব মদ তুলনামূলক কম দামে দেওয়া হতো। স্পিরিট, সুগন্ধিসহ বিভিন্ন ধরণের উপাদানে তৈরি হচ্ছে ভেজাল মদ, যা নামীদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদের বোতলে ভরে বিক্রি করা হতো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় অংশ দেশে আসে। আর চাহিদার কারণে দেশেই ভেজাল ইয়াবা তৈরি শুরু হয়েছে। আবাসিক এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েও ইয়াবার কারখানা করা হচ্ছে। সম্প্রতি এক ভেজাল ইয়াবা কারখানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। আবার চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ কমিশনার গলির এক বাসায় ভাইবোন পরিচয়ে ভাড়া নিয়ে ভেজাল ইয়াবা তৈরীর কারখানা দেয়। পুরো বাসায় ইয়াবা তৈরির যন্ত্র ও কাঁচামাল পায় পুলিশ। পরে সেখান থেকে চারজনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সেখান থেকে ইয়াবা তৈরির দুটি যন্ত্র, আড়াই লাখ ইয়াবা এবং ২০ লাখ ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল উদ্ধার করেছে। মিয়ানমারের ইয়াবার পিস ৪০ টাকা বিক্রি হলেও ভেজাল ইয়াবা ১৫থেকে ২০টাকায় বিক্রি করা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ প্যারাসিটামল এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, চক-উডার, ট্যালকম পাউডার, গ্লুকোজ, বিশেষ ধরণের মোম কেমিক্যাল ও ভ্যানিলা পাউডার দিয়ে ভেজাল ইয়াবা তৈরি করা হয়। আবার ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে আসল ফেনিসিডিল এনে পানি মিশিয়ে ভেজাল ফেনসিডিল তৈরি করে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় বিক্রি করা হয়। প্রতিটি ফেনসিডিলের বোতল এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।


বিজ্ঞাপন