সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক পদোন্নতিতে কৃত্রিম জটিলতা তৈরির আশংকা

শিক্ষাঙ্গন

সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বিধি উপেক্ষা


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সিনিয়র শিক্ষক পদে বড় ধরনের পদোন্নতি দিতে যাচ্ছে। এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নের কাজও চলছে পুরোদমে। ২০১৮ সালে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা-১৯৯১ সংশোধন করা হয়। নতুন সংশোধিত বিধিমালায় সৃষ্ট হয়েছে সিনিয়র শিক্ষক পদ। সিনিয়র শিক্ষক পদোন্নতির জন্য সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের শর্ত সহ সন্তোষজনক আট বছরের চাকুরিকাল যোগ্যতা হিসেবে নির্ধারণ করা আছে।
নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের শর্ত রয়েছে। নিয়োগ বিধিমালা-১৯৯১ ও কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ বিধিমালা-২০১৮ (সংশোধিত ১৯৯১) এর অধীন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি গুলোতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করার শর্ত রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজমুল হক খানের সভাপতিত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পদোন্নতি কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ১০ ফেব্রুয়ারি। এই কমিটির সুপারিশ গোপন রাখায় শিক্ষকেরা নানা ধরনের সংশয়ে রয়েছে। শর্তপালনকারী শিক্ষকদের অভিযোগ, গত পহেলা ডিসেম্বর বিধি অনুসারে একটি তালিকা প্রকাশ করে মাউশি। সে তালিকায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের শর্ত পালনকারীদের যথাযথ স্থান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চলতি বছরের গত ২১ জানুয়ারি সংশোধিত আরেকটি খসড়া তালিকা প্রণয়ন করে তারা। এই তালিকায় শর্ত ভঙ্গকারীদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে মন্তব্য কলামে যোগদানের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড সম্পন্ন করেনি- উল্লেখ করা হয়েছে। মন্তব্য কলামে এই মন্তব্যটি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছে নিয়োগবিধির শর্ত অমান্য হয়েছে। ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা-২০১৮ (সংশোধিত ১৯৯১) ও এর অধীন ১৩ (তেরো)টি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ১৯৯১, ১৯৯২, ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৭, ১৯৯৯, ২০০১, ২০০২, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ অনুসারে সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জনের শর্ত আরোপ করা আছে। নিয়োগ নীতিমালা ও বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রবেশ পদ সহকারী শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হলো- ক) বিএড ডিগ্রি সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক। অথবা; খ) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর। তবে শর্ত থাকে যে, এই ধরনের নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়োগ লাভের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। গ) আরো শর্ত থাকে যে, একটির বেশি তৃতীয়বিভাগ/ শ্রেণি বা সমমান ডিগ্রি গ্রহণযোগ্য হবে না। ২০১৮ সালে সংশোধিত নিয়োগ বিধিমালা অনুসারে নতুন সৃষ্ট সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির যোগ্যতা- সহকারী শিক্ষক হিসেবে সন্তোষজনক ০৮ বছরের চাকুরীকাল; বিএড ডিগ্রি থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, সংশোধিত নীতিমালা অনুসারে সিনিয়র শিক্ষক পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিয়োগ প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। তবে যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে পদোন্নতির জন্য সুপারিশযোগ্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রবেশ পদ সহকারী শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগের পাঁচ বছরের মধ্যে বিএড ডিগ্রি অর্জন করতে হবে- এটা নিয়োগ শর্ত। নিয়োগবিধির শর্ত অমান্য করে অর্জিত যোগ্যতা পদোন্নতির জন্য সুপারিশ যোগ্য নয় বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত জানায়।
বিভাগীয় পদোন্নতি সভা- ডিপিসি’তে নিয়োগ বিধির শর্তপালন সাপেক্ষে কার্যপরিধি নির্ধারণের নির্দেশনা রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি জারিকৃত পরিপত্রে পদোন্নতি সংক্রান্ত কমিটি গঠন ও কার্যপরিধির ২নং ধারার খ) এর (অ) এ বলা হয়েছে – ‘সংশ্লিষ্ট নিয়োগবিধির শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও তদাধীন অধিদপ্তর/পরিদপ্তর/দপ্তরের দশম, একাদশ, দ্বাদশ গ্রেডভুক্ত স্বীকৃত ২য় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি/ উচ্চতর টাইমস্কেল/সিলেকশন গ্রেড প্রদানের বিষয় বিবেচনা পূর্বক সুপারিশ করা।’ অথচ মাউশির কিছু কর্মকর্তা বিধি বিধানের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেখিয়ে শর্ত অমান্যকারী সকলকে নিয়ে মানবিক কারণে পদোন্নতি দিতে চাচ্ছে। এতে তাদের মানবিক কারণ ছাড়াও অন্য কোনো স্বার্থ থাকার ইঙ্গিত করছে নিয়োগ বিধির শর্ত মান্যকারী শিক্ষকরা। তারা অভিযোগ করে, যারা শর্ত ভঙ্গ করেছে তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে দীর্ঘদিন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। পক্ষান্তরে শর্ত ভঙ্গকারীরা তাদের বেতন ভাতাদি ঠিকই ভোগ করছে। উপরন্তু কেউ কেউ প্রাইভেট-টিউশনি করে সম্পদের মালিক হয়েছে। ব্যস্ততার কারণে নিয়োগের শর্ত পালন করার গুরুত্ব পর্যন্ত বুঝতে চায়নি। অথচ তাদের জন্য কতিপয় কর্মকর্তা বিশেষ করে উপপরিচালক (মাউশি) মো. আজিজ উদ্দিনের অতি আবদার সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির জন্য গঠিত ডিপিসি সভায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন ছক অমান্য করে মাউশি অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মাধ্যমিক) মো. আজিজ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ডিপিসি সভার একটি নির্দিষ্ট ছক রয়েছে। এর বাইরে কারো থাকা বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। শিক্ষকদের সংশয় ডিপিসির পূর্বে সুনির্দিষ্ট করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে বলেছেন, ২০০৯ পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকগণ সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাবে। সিনিয়র শিক্ষক পদের সংখ্যা ৫৪০৭ টি। সিনিয়র শিক্ষক পদে পদোন্নতির জন্য বিএড শর্ত প্রযোজ্য নয়। এটি সহকারী শিক্ষক নিয়োগ শর্ত।
ডিপিসি সভার পূর্বে পদোন্নতি সংক্রান্ত বিব্রতকর এমন মন্তব্য প্রদান করে সে শিক্ষকদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। তার বিরুদ্ধে শর্ত ভঙ্গকারী শিক্ষকদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাভবনে প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপপরিচালকের অফিসকক্ষে একজন প্রধান শিক্ষক ও কয়েকজন সহকারী শিক্ষক পারস্পারিক শলা পরামর্শ করে থাকেন। মূলত তাদের মাধ্যমে জ্যেষ্ঠতা তালিকায় শর্ত অমান্যকারীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে পদোন্নতি পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। মাউশি থেকে ডেপুটেশন না পাওয়ায় শর্ত পালনে বিলম্ব করেছে বলে উপপরিচালক বিভিন্ন মাধ্যমে মতামত দিয়েছে।
শিক্ষকরা জানায়, অনেকে ২৫-২৯ বছর পর বিএড ডিগ্রি অর্জন করেছে। অথচ কতিপয় কর্তা ব্যক্তি নিজের ডিপার্টমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে খোড়া যুক্তি দেখাচ্ছে মাউশি তাদের ডেপুটেশন দেয়নি। বিধিমতে চাকুরিতে নিয়োগকৃত ব্যক্তিকে স্বপ্রণোদিত হয়ে শর্তাধীন সময়ের বিএড ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ডেপুটেশন অনুমোদন হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শর্ত ভঙ্গকারীরা ডেপুটেশন চেয়ে আবেদন করেছে এমন কোনো আবেদন মাউশিতে জমা নেই। যার অর্থ তারা ডেপুটেশন চায়নি। সাধারণ শিক্ষকরা বলেন, শর্ত ভঙ্গকারীদের অনেকে ডেপুটেশন দেয়ায় তারা নিজেরা আবেদন করে সেই ডেপুটেশন কর্তন করেছে, যা প্রশিক্ষণ শাখায় জমা আছে।
শর্ত মান্যকারী শিক্ষকদের অভিযোগ, তারা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে বিধি বিধানের আলোকে পদোন্নতি দিতে লিখিত আকারে জানিয়েছে। তারপরও কর্তৃপক্ষ বিধি বিধান অনুযায়ী পদোন্নতি দিতে অস্বীকৃতি জানালে আইনী পদক্ষেপ নিতে তারা বাধ্য হবে বলে নিশ্চিত করেছে। তারা আরো জানায়, সুপারিশে যাদের শর্ত পূরণ আছে তাদের পদোন্নতি যাতে স্বাভাবিকভাবে হয়ে যায় তার ব্যবস্থা রেখে শর্ত ভঙ্গকারীদের পদোন্নতি আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্থগিত করে দিতে ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। তবে পদোন্নতির জন্য বিতর্কিত সুপারিশ প্রদানকারী সংশ্লিষ্টদেরও আদালতের মুখোমুখি হতে একই আইনী প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে বলে সাধারণ শিক্ষকরা নিশ্চিত করেছে।
সূত্রমতে জানা যায়, এই সেক্টরে দীর্ঘদিন চাকুরি করেও পদোন্নতি না পেয়ে শিক্ষকদের অবসরে যেতে হয়। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও মুজিববর্ষে সাধারণ শিক্ষকগণ বিধি অনুযায়ী পদোন্নতি পেতে আগ্রহী।