রাত্রির শেষপ্রহরে নীলকন্ঠ রায়ের ঘুম ভেঙ্গে গেল ভীষন জলতেষ্টায়

অন্যান্য বিবিধ সাহিত্য

কাজি আরিফ : ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। গা ঘেমে নেয়ে উঠল। মাঝির বৈঠা আর পানির সংযোগে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে এলো। হাত বাড়িয়ে জল খেতে যাবার সময়ে দেখতে পেল একটা ছায়া শরীর দ্রুত কাছে এসে লন্ঠনটা বাড়িয়ে টেবিলে রাখা রাজস্থানী নক্সাদার কাঁসার জগ থেকে একটি কাঁসার গ্লাসে জল ঢাললো।


বিজ্ঞাপন

ওটা শিবু।
দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী। ওকে পেয়েছিল ভৈরবের পাড় থেকে ।অনাথ অবস্থায়। মা বাবা কলেরায় নিকেশ হলে একমাত্র ওই শিবু টিকে গিয়েছিল।নির্বংশ হওয়ার পর থেকে শিবু জায়গা পেয়েছে নীলকান্ত রায়ের বৈঠকখানায়। প্রথমদিকে ফাই ফরমাস খাটত , এটা ওটা আনত, তামাক সাজিয়ে দিত। ভেতর ঘরে নেওয়া হতোনা। ধীরে ধীরে সে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে।ওর সততা ও নির্লোভ চরিত্র ওকে জমিদার নীলকন্ঠ রায়ের কাছে আনতে সহায়ক হয়ে উঠেছে।
এখন ওর বয়স প্রায় পঁচিশ,সুঠাম দেহ আর ঝাকড়া চুল । নীলকান্ত বাবু ঠিক করেছেন ওকে বিবাহ দিয়ে দূরে কিছু জমি দান করবেন। চাষাবাদ করে খাওয়ার সুযোগ করে দেবেন।দরকার হলে অন্যপরগনায় পাঠিয়ে দিবেন।কেননা এ কয়েকবছরে ছেলেটার প্রতি একটা সন্তানসম মায়া তৈরী হয়েছে বৈকি। যার প্রতি মায়া বেশী তাকে সবসময় দূরে পাঠানোই ভাল। তাতে দুর্বলতা কম হয়। কিন্ত তার মেয়ের বেলায় সেটা রক্ষা করতে পারেনি।

জল খেতে খেতেই শব্দ কানে এল। মাঝিদের আহাজারি চিৎকার। উনি প্রশ্ন নিয়ে শিবুর দিকে তাকালেন।ব্যাপারটা বুঝার জন্য শিবু বাইরে পা বাড়ালেই তারপর দুজন তিনজন করে আওয়াজটা বাড়ল। এরমধ্যে খিটখিটে স্বভাবের নায়েব সাহেবের ঘুমটাও ভেঙ্গে গেছে ।সে যারপরনাই সবার উপর খুব বিরক্ত। তিনি সর্বদাই রাগান্বিত থাকতে পছন্দ করেন। তিনিও ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে দেখলেন । দূর পূবাকাশে হালকা আলোর দিশা। ভগবানের নাম করতে করতে ফিরে এসে বিছানায় বসে মাঝিদের শাপশাপান্ত করতে লাগলেন।
– যত্তোসব উজবুকের দল! আমার নিদ্রাটা টা সাবাড় করে দিল!

শিবু এসে ধীর পায়ে একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
‘কর্তা, নৌকার বৈঠায় একটা লাশ বেধেছিল।’
শোনা গেল, লাশের গায়ে জামাকাপড় দেখে মাঝিদের মনে হয়েছে মৃতব্যক্তি বড় ঘরের কেউ হবে । গলায় হাতে সোনার অলংকার ।বোঝা যায়নি অপঘাত নাকি রোগবালাইয়ে মৃত্যু ?
মৃত্যুর কথা শুনে মনে কু গাইল রাজা নীলকন্ঠ রায়ের।কেমন জানি দুশ্চিন্তা শুরু হল। বৈঠায় লাশ পড়া ভাল লক্ষন নয়, একটা অমঙ্গলের আশংকায় কেঁপে উ্ঠলেন তিনি।

প্রায় মাসের অধিককাল তিনি তার রাজ্যের বাইরে। রাজ্যের নিরাপত্তা , নিজের গতিবিধির নিরাপত্তার চিন্তা তার কম না। সুন্দরবন এলাকার হার্মাদ জলদস্যুরা তার দুশ্চিন্তার বড় কারণ।সম্প্রতি তাদের ডাকাতি কার্যক্রম অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।যত্রতত্র তাদের আনাগোনার কথা তাদের কতৃক আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এও শোনা যাচ্ছে তারা কোথাও কোথাও নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া রাজ্যে উলাউঠা,কলেরা, দাস্তবমি, কালাজ্বর এসব ত আছেই। একটা রাজ্য চালানো সহজ কম্মো না। তার উপরে বিশ্বাসী লোকের এত অভাব যে কোথাও ভরসা পাওয়া যায়না। কারোর উপর না। এসব ভাবতে ভাবতে শান্ত লক্ষী মেয়েটার মুখটা ভেসে উঠল।

তার মেয়ে অভয়া।

বয়স এগারো কি বারো। মাত্র এক সন আগে তাকে বিবাহ দেয়া হয়েছে আরেক জমিদার পুত্র নীলাম্বরের সাথে।নীলকান্তের এলাকার পাশেই তার জমিদারী ,নড়াইলের জমিদারের পুত্র নীলাম্বর। ভীষন সুপুত্র। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই তার আচার ব্যবহার। সবচে বড় কথা মেয়েটা খুব কাছে আছে । নড়াইল বেশি দূর ত না ।আট ক্রোশের মত । পালকীতে গেলে একদিনেই পৌছানো যায়। আর বর্ষাকালেও নৌকায় একদিনে পৌছানো সম্ভব ।

অভয়া তার কলিজার একাংশের মত।
অনেকদিন বিবাহ হয়ে যাবার পর নিঃসন্তান ছিলেন নীলকন্ঠ রায়। শিব মন্দিরে একবার শিবের পায়ে করজোড়ে প্রার্থনা করেছিলেন একটি সন্তানের জন্য।বড় করে যজ্ঞ করার পর তার স্ত্রী লক্ষীদেবীর গর্ভ হয়। তারপর বৈদ্যের অনেক নির্দেশ মেনে চলার পর রাজবাড়ি আলো করে এসেছিল এই অভয়া ।নীলকন্ঠ এত খুশী হয়েছিলেন যে তিনি তার রাজবাটিসহ এলাকার নাম রেখেছিলেন অভয়ানগর।ধীরে ধীরে লোকমুখে এলাকার নাম হয় অভয়নগর ।

আইবুড়ো হওয়ার আগেই মেয়ে অভয়াকে তুলে দিয়েছিলেন জমিদারপুত্র নীলাম্বরের কাছে। বিয়ে দেয়াতে না হয় মেয়েটার ব্যবস্থা হল কিন্ত মেয়েটার অবর্তমানে নীলকন্ঠর ভাল লাগেনা । মেয়ের জন্য বুকের একপাশে শূন্যতা অনুভব করেন।তার এত বড় জমিদারী কিন্ত তারপরেও মেয়েটার জন্য এক অন্যরকম শুন্যতা টের পান তিনি। । এই ক্ষমতা এই রাজত্ব তার কিছুই ভাল লাগেনা।কিন্ত তার একা ভাল লাগা বা খারাপ লাগার উপরে কিছুই নির্ভর করেনা।কেননা তার সাথে হাজার হাজার প্রজার ভালমন্দ জড়িত, স্বার্থ জড়িত।তাই তাকে জমিদার হয়ে থাকতেই হয়। সেখানে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই তেমন।

তার খুব ইচ্ছা হয় মেয়েটা তার কাছে থাকুক, চারপাশ আলোকিত করে রাখুক। কিন্ত তার মেয়ে ব্রাম্মন ঘরের রাজকন্যে বা জমিদারকন্যে তাকে ত পাত্রস্থ করতে হবে সময়মত। জমিদার হয়ে মেয়েকে আইবুড়ো করলে প্রজারা কানাকানি করে দুকথা বাতাসে ছড়াবে, তাইত নড়াইলের নীলাম্বরকে পেয়ে যাওয়ায় মেয়েটাকে তার হাতে সঁপে দিতে পেরে তিনি নিজে খুশী ছিলেন। যদিও তার পিতৃহৃদয় সে খুশীতে বাঁধা দেয়।মেয়েটাকে তবু তো অন্যঘরে পাঠাতে হল।

আচ্ছা , মেয়েটা ভাল আছে তো?

একবার ভাবে বজরা সোজা অভয়ার শ্বশুরবাড়ি নড়াইলের নদী চিত্রার দিকে চালিয়ে দেবে নাকি? ভৈরব দিয়ে আফ্রা নদী হয়ে নড়াইলের চিত্রায় যাওয়া যায় বটে। কিন্ত এত লোক লস্কর পাইকপেয়াদা , সৈন্যসামন্ত নিয়ে গিয়ে একটা বিড়ম্বনা তৈরী না করাই শ্রেয় মনে করলেন।

কিন্ত নৌকায় লাশ বাধা পড়া ভাল লক্ষণ নয়। মনটা খচ খচ করতে লাগলো।কারো কোন অমঙ্গল হলোনা তো?

বিভাগদী বা অভয়ানগরে পৌছাতে তার এখনো দুইদিন লাগবে। অভয়ানগর নামটা এখনো অতোটা পরিচিত না মানুষের কাছে। তারচে এলাকার বাঘুটিয়া ভাটপাড়া,রাজঘাট,শংকরপাশা, মহাকাল,চেংগুটিয়া নামগুলো অনেকবেশী পুরনো ও পরিচিত। তার নিজ এলাকার নাম অভয়ানগর রাখা হলেও সেখানে যথেষ্ট পরিমান ভয় বিরাজ করে থাকে।জীবনের ভয়, ক্ষমতা হারানোর ভয়, যশ হারানোর ভয়। একদা নীলকন্ঠর পূর্বপুরুষ রাজা প্রতাপাদিত্য গৌড়ের যশ হরণ করেছিলেন বলেই হয়ত তাদের আদি রাজ।