মরুযাত্রায় টিকার চুক্তি!

এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

দিশেহারা নিম্মমধ্যবিত্ত, নিঃস্ব-রিক্ত নিম্নবিত্তরা


বিজ্ঞাপন

 

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাখাতে চলছে চরম অরাজকতা। রয়েছে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তার অভাব। নেই পর্যাপ্ত তদারকি ও পরিদর্শন ব্যবস্থা। ফলে কার্যত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে এ খাত। তাই চিকিৎসাখাতে সেবাগ্রহীতারা রয়েছেন জিম্মিদশায়। নিশ্চিত হচ্ছে না মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা; বরং বিপুল আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত ক্ষুদ কর্মকর্তা-কর্মচারিরাই এমনটা মনে করছেন। একদিকে ভারতের সঙ্গে চুক্তির পরও টিকা না পাওয়া অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসায় জমানো টাকা খরচ করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে যাওয়া মানুষদের কথা ভাবতেই যেনো অনেকের শরির শিউরে উঠে। তাই সেরামের সঙ্গে করা চুক্তি ছাড়াও চীন, আমেরিকা, রাশিয়া থেকে টিকা পাওয়াকে মরুযাত্রার মতোই দেখছেন তারা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দ্বিতীয় ডোজের জন্য ঘাটতি ১৬ লাখ টিকার জন্য বারবার অনুরোধ করে এবং কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে। দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি মেটাতে যুক্তরাজ্যের কাছে অনুরোধ জানিয়েও সুখবর মেলেনি। এখন কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দ্বিতীয় ডোজের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। কিন্তু কোথাও কোনো সুখবর নেই। অথচ ১৮ কোটি জনগোষ্ঠীর ১৭ কোটিই এখনো টিকার বাইরে। এর আগে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তি হলেও ভ্যাকসিন দিতে পারেনি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। বরং টিকা রপ্তানিই বন্ধ করে দিয়েছে ভারত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশের টিকা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ সংকট আখ্যা দিয়ে বলেছেন, টিকা পেতে আমরা মরিয়া। কারণ, ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ রাখায় বাংলাদেশ ১২ সপ্তাহের মধ্যে ১৬ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দিতে ব্যর্থ হবে। আমরা টিকার বিষয়ে ভারতকে চিঠি দিয়েছি।
এ বিষয়ে ভারত এক চিঠিতে বাংলাদেশকে জানায়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে কোনো টিকা দেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী অক্টোবরের আগে ভারত টিকা রপ্তানি করবে না। ফলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ টিকার দেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা দিতে দেরি হলে করোনার নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে।
সম্প্রতিতে দেখা গেছে, দেশে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি। এছাড়া চীনের সিনোফার্ম টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্যও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে কমিটি সুপারিশ করে। একইসঙ্গে করোনার বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বন্ধ রাখার জন্যও সুপারিশ করে।
যদিও টিকা সংকট পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে টিকা পেতে বাংলাদেশ যোগাযোগ শুরু করে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে। টিকা চাওয়া হয় যুক্তরাজ্য ও কানাডার কাছেও। কিন্তু আশ্বাস মিললেও কোনো জায়গা থেকেই দ্রুত টিকার পাওয়ার নিশ্চয়তা পায়নি বাংলাদেশ।
কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন পেতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চিঠি দিলেও টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকার তালিকায় নেই বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের টিকা পেতে জটিলতা আছে। জটিলতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এই অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন রপ্তানির অনুমোদন দিতে অনেক সময় নিচ্ছে।
জানা গেছে যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে অনুমোদন করেছে, তাই এফডিএ এটি অনুমোদন না করলেও যুক্তরাষ্ট্র যদি টিকার চালান পাঠাতে রাজি হয়, বাংলাদেশ অবিলম্বে তা নিতে রাজি আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার প্রায় ৬ কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে।
এদিকে চুক্তি অনুযায়ী সময়মতো ভারত থেকে টিকা না পাওয়ায় গণটিকাদান কার্যক্রম স্থগিত আছে। করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়ায় দেখা দিয়েছে নতুন সংকট। কিন্তু সংকটে নেই টিকার মজুত। তাই জরুরি ভিত্তিতে চীন ও রাশিয়া থেকে টিকা আমদানি করে সংকট মোকাবিলার চেষ্টা থাকলেও তা সহসাই পাওয়ার আশা নেই। কূটনীতিক সূত্রগুলো জানায়, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আর চীনের টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় টিকা পেতে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
এদিকে দেশে মহামারী করোনা হানা দেওয়ার পর পার হয়ে গেছে বছরের বেশি সময়। করোনায় এ পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৮ লক্ষাধিক মানুষ। করোনা রোগীর চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বে মানুষ স্বজনদের বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। কেউ বেঁচে ফিরছে। চেষ্টা সত্ত্বেও অনেককেই বাঁচানো যাচ্ছে না। এই ব্যয় মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবারকে পথে বসতে হচ্ছে। করোনার কারণে এমনিতেই অসংখ্য মানুষের আয় কমেছে। চাকরি হারিয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চিকিৎসা ব্যয়। সবকিছু মিলে দিশেহারা অবস্থা নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের।
এক প্রতিবেদনের আলোকে জানা গেছে ব্যবসায়ী ফরহাদ হোসেনের মাসে যা আয় হতো তা দিয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ বেশ ভালোভাবেই হতো। করোনা আক্রান্ত মাকে বাঁচানোর চেষ্টায় দিনে লাখ টাকার বেশি গুনতেও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু মা ফাতেমা রহমান আইসিউ থেকে আর বাড়ি ফিরলেন না। চিকিৎসার জন্য করা ধার-দেনা মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে পুরো পরিবার।
ঢাকার একটি হাসপাতালে এক মাসের বেশি সময় চিকিৎসা নেওয়ার পর গত ২ মে রাতে মারা যান তিনি। পরিবারটিকে আইসিইউর ৩১ দিন ৮ ঘণ্টা ৪ মিনিটের বিল চুকাতে হয়েছে। এর আগে করোনায় মারা যান ফরহাদের বড় বোনোর স্বামী। তার চিৎিসা ব্যয়ও মেটাতে হয়েছে ফরহাদকে। একান্ত আপন দুই স্বজনের চিকিৎসার পেছনে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার।
ঠাকুরগাঁওয়ে বীজ ও কৃষি পণ্যের ব্যবসায়ী ফরহাদ বলেন, আইসিইউতে একেক দিনের বিল আসত ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা। কোনো কোনো দিন লাখ টাকার শুধু ওষুধই কিনতে হয়েছে। সেই ধার শোধ দিতে এখন সম্পত্তি বিক্রির কথা ভাবতে হচ্ছে। ফরহাদ পারলেও প্রিয়জনের চিকিৎসার জন্য ধার-দেনা করেও এত টাকা জোগাড় করার সামর্থ্য আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের নেই।
এমন বিষয়ের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকদের অভিযোগ, নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উদাসীন। একাধিক শক্তিশালী সিন্ডিকেট সরকারি চিকিৎসাসেবায় নানামুখী অরাজকতা সৃষ্টি করে রোগীদের ঠেলে দিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নানা কৌশল নিচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতাল মালিকরা।
তারা প্রভাবশালী রাজনীতিক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের হাসপাতাল এবং ক্লিনিকের মালিকানায় অংশীদার বানাচ্ছেন। সরকারি চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ নেই। তাই বেশি অর্থ খরচ করেও বেসরকারি চিকিৎসাসেবার দিকে ঝুঁকছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সেখানেও মুনাফাভিত্তিক বাণিজ্যের কবলে পড়ছেন তারা।
সম্প্রতি চিকিৎসাসেবায় সরকারি-বেসরকারিখাতের প্রতারণা বন্ধের জন্য একটি কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। চিকিৎসাসেবার ওপরে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেসরকারি পর্যায়ের ৬৬টি হাসপাতাল এবং ৫০টি রোগনির্ণয় কেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং এতে বেসরকারি চিকিৎসা খাতসংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি পর্যালোচনা, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসাসেবা, বেসরকারি চিকিৎসাসেবার বিপণনব্যবস্থা, তথ্যের স্বচ্ছতা এবং তদারকির বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়।
এ গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বেসরকারি চিকিৎসাসেবা খাতে বাণিজ্যিকীকরণের প্রবণতা প্রকট এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবায় সরকারের যথাযথ মনোযোগেরও ঘাটতি রয়েছে। এতে একদিকে এটি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে কিছু ব্যক্তির এ খাত থেকে বিধিবহির্ভূত সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।