একজন পরী ও মুক্তিযুদ্ধ-১

বিবিধ

সাবরীনা মান্নান : আমি তাকে দেখেছিলাম নড়াইলে, আমার দাদা বাড়িতে। তখন আমার বয়স ছয় বা সাত বছর। হঠাৎ দুপুরে তিনি এলেন, অনিন্দ্য সুন্দরি একজন নারী, আমি দাদীজানকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি পরী? তখন আমি খুলনা আগাখান স্কুলে পড়ছি, ইংরেজি মাধ্যমের বইগুলোতে পরী নিয়ে অনেক অনেক গল্প থাকে, আমার কল্পনাতে তখন থেকেই একটি পরী বাসা বেঁধে নিয়েছে।


বিজ্ঞাপন

দাদীজান বললেন, না গো ময়না, ও তোমার সেজো চাচী। খুলনা পশ্চিম বানিয়া খামার, “শাহানা মঞ্জিল ” (আমার মায়ের নমে করা বাড়ি,আজ অবধি এ নমেই বাড়িটি রয়েছে,যদিও জীবনের প্রয়োজনে বাবা বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন) আমাদের বাড়ি, বাবা সে বাড়িটি করেছিলেন নিজের খেয়ালে, এখনো মনে পড়ে, লাল রঙের শিড়ি ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে উঠে গেছে দোতলায়। সে বাড়িতেই দেখেছি বাবার ছবির পাশে বাঁধাই করে টানানো সেজো চাচার ছবি, বুদ্ধিদীপ্ত এক রাজপুত্র যেনো!
তিনি আমার সেজো চাচা “মেজর মোজাম্মেল হোসেন”

অবাক হয়ে সেদিন চাচীকে দেখেছিলাম, আমাকে কোলে নিলেন, হাতে পরা একটি আংটি দেখিয়ে বললেন যুদ্ধে যাবার আগে তোমার চাচা পরিয়ে দিয়ে গেছেন, দেখো কি সুন্দর! বলেই চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি সে সময়ে তেমন কিছুই বুঝিনি, বোঝার বয়সও হয়নি,পরবর্তীতে মায়ের কাছে পরীর কাহিনী শুনেছি, এখনো হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে তার মুখখানি, আহা মানুষ এত সুন্দর কেমন করে হয়!

পরীর সাথে আমার চাচার কেবল আংটি বদল হয়েছিলো,বিয়ে নামক আনুষ্ঠানিকতা হয়নি,
তারা ভীষণ ভালোবাসতেন দুজন দুজনকে, তারপর চাচা যুদ্ধে গেলেন, পরী দিনের পর দিন গাছতলায়, নদীর ঘাটে, বসে থেকেছেন, চাচার অপেক্ষায়, শেষের দিকে প্রায় পাগলের মতো ছুটে আসতেন আমাদের বাড়িতে। চাচার কোনো খবর পাওয়া যায় কি না,এ আশায়।

অবশেষে এলো সেই চিঠি, চাচাকে পাক বাহিনী আঁটকে রেখেছে যশোর সেনানিবাসে। কি অত্যাচার! উল্টো করে ঝুঁলিয়ে পিটাচ্ছে, ডালের পানি খেতে দিচ্ছে, তিনি লিখেছিলেন “মা অনেকদিন ভাত খাইনা’ শেষ একটি লাইন ছিলো ” মা তোমার পাঁচ ছেলে,একজন দেশের জন্য প্রাণ দিলে কষ্ট পেও না” আমি পড়েছি সে চিঠি, একটি পোস্ট কার্ড। বন্দীশালা থেকে হয়তো কোনোভাবে তিনি পাঠিয়েছিলেন তার শেষ অনুভূতি।

আমার দাদী সে চিঠি পড়ে দীর্ঘ আটমাস কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, অন্য কোনদিন লিখবো সে কথা হয়তো। কি পরম মমতায় একজন মুক্তিযোদ্ধার মা দিনের পর দিন মিটসিফে খাবার রেখে দিতেন, কেউকে স্পর্শ করতে দিতেন না সে খাবার, তার তিন ছেলে যে যুদ্ধে গেছেন।

সে চিঠি পড়ে পরী পাগল হয়ে যায়, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো, সবাইকে বলতো, তোমরা আমায় চেনো না, আমি মোল্লা বাড়ির সেজো বউ। কোনদিন আর বিয়ে করেননি, কেউকে ভালোবাসি বলেননি, তার শেষ উচ্চারণে আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা চাচার নামই ছিলো, সেজো চাচার মৃতদেহ বা আর কোনো খোঁজ আমার পরিবার পায়নি।

অবশ্যই পরী আমাদের বাড়ির বউ ছিলেন, আমার দাদাজান গ্রাম চেয়ারম্যান “রোকন উদ্দিন মোল্লা” পরীকে সমান সম্পওি দিয়ে সে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন……

দীর্ঘদিন আমি বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়~ Bangladesh and Global Studies বিষয়টি ইংরেজি ও বাংলায় শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি, বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর চেষ্টা করেছি, নিজ পরিবারের ইতিহাস, আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা এম এ মান্নান কোন অভিমানে নিজেকে সারাজীবন আড়াল করে গেছেন, হয়তো লেখার সময় হয়েছে,আমি অবশ্যই লিখবো…..