জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে ডেঙ্গু

জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা রাজধানী

২৯৯ জনের প্রাণহানি

বিশেষ প্রতিবেদক : ডেঙ্গু হলে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন। কিন্তু ডেঙ্গুর দায় কিন্তু তাদের নয়। ডেঙ্গুর দায় আমাদের মানে নাগরিকদের। আর বড় দায় সিটি করপোরেশনের। ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশায়। আর এডিস মশা কোথায় বংশবৃদ্ধি করে সেটা আমরা সবাই জানি। গত অনেক বছর ধরেই ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে সচেতনতার কথা হচ্ছে। কিন্তু ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। ছন্দ মেলাতে রাতের মশার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এডিস মশা রাতের নয়, দিনের মশা।
জমে থাকা পরিস্কার পানিতে এডিস মশা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো এডিস মশার বংশ ধ্বংস করে দেয়া। সাবধানতাগুলো খুব কঠিন নয়। বাড়ির আনাচে কানাচে পানি জমতে না দেয়া, ডাবের খোসা, ভাঙ্গা টব বা অন্য কোথাও বৃষ্টির পানি জমতে না দেয়া। তবে এবার বেশি শোনা যাচ্ছে নির্মাণযজ্ঞের কথা। ঢাকায় অনেকবছর ধরেই চলছে এই অপরিকল্পিত নির্মাণযজ্ঞ। নির্মাণকাজ চলার সময় অনেক ভাঙ্গাচোড়া জিনিস পড়ে থাকে। তার কোনটা পানি জমে থাকে কে জানে। আর নির্মাণকাজ চলার সময় সেই জায়গাটি সার চোখের আড়ালে থাকে। তাই সাধারণ মানুষের পক্ষে জানাই মুশকিল কোথায় এডিস মশা তার বংশবৃদ্ধি করছে। তাই আপনার ঘরকে মশামুক্ত করলেও কিন্তু আপনি নিরাপদ নন।
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫০ শতাংশ সাধারণ ও মারাত্মক ধরনের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বর্তমানে প্রতি বছর মারাত্মক ধরনের ডেঙ্গু (হেমোরেজিক) জ্বরে কমপক্ষে ৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি মিনিটেই বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই শিশু। আক্রান্তদের মধ্যে বছরে ২২ হাজার ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে গ্রীষ্মম-লীয় দেশগুলোতে এ রোগে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুহার প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের (গ্লোবাল ওয়ার্মিং) কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বরফ গলছে ও সুনামীসহ ঝড় হচ্ছে। এ সবের ফলে বর্ষাকালের সময় বৃদ্ধি, অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বহু মানুষ খোলামেলা স্থানে বসবাস করতে বাধ্য হয় এবং মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন!
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসক ও নার্সসহ প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত ও সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা শুরু করা না গেলে আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ২০ জনের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। তবে দ্রুত শনাক্ত ও প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে চিকিৎসা করা গেলে মৃত্যু ঝুঁকি শতকরা ১ ভাগেরও নিচে নেমে আসে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মশার প্রজনন দ্রুত হয়। মহিলা (ফিমেইল) মশার কার্য়কারিতা বাড়ে। মশার সংক্রমন হওয়ার জন্য যে ইউকিউবিশন সময় প্রয়োজন হয় তা কমে যায়। আগে যে সব জায়গায় মশা থাকতে পারত না তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সে সব জায়গাতে অবস্থান করতে পারে। বিশেষ করে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পাত্রে জমিয়ে রাখার কারণে ডেঙ্গুবাহী এডিশ মশার প্রজনন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে মালয়েশিয়াতে ডেঙ্গু জ্বরে ৪৬ হাজার আক্রান্ত ও ৭৪ জনের মৃত্যু, ফিলিপাইনে ৭২ হাজার আক্রান্ত ও ৩০৩ জনের মৃত্যু, সিঙ্গাপুরে ৩ হাজার ২৩৩ আক্রান্ত, ভিয়েতনামে ৬০ হাজার আক্রান্ত ও চারজনের মৃত্যু ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৬ হাজার ৮০৭ জন আক্রান্ত ও ৭ জনের মৃত্যু, মিয়ানমারে ৪ হাজার আক্রান্ত ও ১৪ জনের মৃত্যু এবং থাইল্যান্ডে ২৬ হাজার আক্রান্ত ও ৪১ জনের মৃত্যু হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের কারণে জয়বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। যার প্রভাবে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসে আদ্রতার পরিমাণও বেড়েছে। কখনও খরা, আবার কখনও বা অতিবৃষ্টির ফলে ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা অনেক কম।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী ডেঙ্গুতে মৃতের হার ১ শতাংশের কমে থাকতে হবে। সেই মানদ- অনুযায়ী দেশে মৃতের হার ১ শতাংশের অনেক কম।
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, জনসচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদ্যোগে বর্ষার আগে, বর্ষার সময় ও বর্ষার পরে মশার ওপর জরিপ চালানো হয়। এ ছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের ডেঙ্গু রোগ ও রোগীর চিকিৎসা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়ায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে এসেছে।
মশার কামড়ে ২৯৯ জনের প্রাণহানি : গত দুই দশকে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার কামড়ে ২৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু সরকারি হিসাবেই এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে এ সময়কালে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শয্যাশায়ী হয়েছেন ৫২ হাজার ৮৪০ জন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তারা বলেন, অনেক সময় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও অনেকেই হাসপাতালে আসেন না, অনেকেই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বার ও ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খান।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যুর শিকার ২৯৯ জনের সুদীর্ঘ তালিকায় ছোট্ট ফুটফুটে শিশু থেকে শুরু করে গৃহবধূ, চিকিৎসক, সংবাদ পাঠিকা, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার ও চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, যারা ডেঙ্গুতে মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই সুস্থ ও সবল দেহের ছিলেন। একদিন হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন এমন অনেক তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আকতার জানান, ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ডেঙ্গুতে মোট ৫২ হাজার ৮৪০ জন ভর্তি হন।
বছরওয়ারী প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ৫ হাজার ৫৫১, ২ হাজার ৪৩০, ৬ হাজার ২৩২, ৪৮৬ জন, ৩ হাজার ৪৩৪, ১ হাজার ৪৮, ২ হাজার ২০০, ৪৬৬ জন, ১ হাজার ১৫৩, ৪৭৪ জন, ৪০৯, ১ হাজার ৩৫৯, ৬৭১ জন, ১ হাজার ৭৪৯, ৩৭৫ জন, ৩ হাজার ১৬২, ৬ হাজার ৬০, ২ হাজার ৭৬৯, ১০ হাজার ১৪৮ ও ২ হাজার ৬৬৪ জন।
এ সময়কালে (২০০০ থেকে ২০১৯ সাল) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃত্যু হয় ২৯৯ জনের। বছরওয়ারী পরিসংখ্যান অনুসারে মোট মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে ৯৩ জন, ৪৪, ৫৮, ১০, ১৩, ৪, ১১, ৬, একজন, দু’জন, ৬, ১৪, ৮, ২৬ ও তিনজন।
গত প্রায় দুই দশকে দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলেও ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। মশক নিধন ও নিয়ন্ত্রণে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (দক্ষিণ ও উত্তর) প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার মশার ওষুধ ছিটালেও কাজ হচ্ছে না। ডেঙ্গু জ্বরের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসা গাইডলাইন তৈরি করেছে।
চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। জনসচেতনতা বাড়াতে সারাদেশে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণ ও ধ্বংস করতে তারা জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটালেও কাজ হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ সম্পর্কে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অভিজাত এলাকায়ই ডেঙ্গু মশার প্রকোপ বেশি। তারা কেউ শখ করে বাগান তৈরি করেন; কেউবা বাড়িতে কৃত্রিম ঝরনা বসান। এছাড়া ঘরের এয়ারকন্ডিশনের জমে থাকা পানি পরিষ্কার করেন না। এ সব কারণে অভিজাত বাসাবাড়িতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার বেশি। ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে চাইলে সরকারের চেয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জনসচেতনাই বেশ প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।


বিজ্ঞাপন

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *