ট্রেনে কাটা পড়ে ৫৩৬ প্রাণহাণি

অপরাধ এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

হেডফোন ও অসতর্ক মোবাইল ব্যবহার

বিশেষ প্রতিবেদক : মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাজধানীর মালিবাগে রেললাইনে ধরে হাঁটছিলেন এক তরুণ। পেছন থেকে ডাক দিতেই হতচকিত হয়ে উঠলেন। নাম জানতে চাইলে ইতস্তত বোধ করলেন।
এভাবে ফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনের ওপর দিয়ে হাঁটছেন কেন- জানতে চাইলে লাজুক ভঙ্গিতে জানালেন, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু এটা তো বিপজ্জনক হতে পারে- এমন মন্তব্য উপেক্ষা করে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে আবার কানে ফোন দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন।
না এই যুবকের কোনো বিপদ হয়নি। তিনি নিরাপদেই হেঁটেছেন। তবে সবাই যে তার মতো ভাগ্যবান এমন নয়। সরকারি নথিপত্র বলছে, এই যুবকের মতো কেবল ফোনে কথা বলতে বলতে বা হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ঢাকায় বছরে ৫০ জনের মৃত্যু হচ্ছে কেবল ট্রেনে কাটা পরে।
রেল পুলিশের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০১৯ এর জুলাই পর্যন্ত কানে হেডফোন ও অসতর্ক ফোন ব্যবহার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ গেছে ৫৩৬ জনের।
এই ‘রোগের’ কী সমাধান, সে বিষয়ে রেল কর্মকর্তা বা রেল পুলিশের কোনো ধারণাই নেই। যদিও এই মৃত্য তাদেরও ব্যথিত করে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, হাঁটার সময় এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। নিজের জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফোনে নিবিষ্ট থাকলে মনোযোগ আশপাশে থাকে না। ফলে ট্রেন আসছে কি না, সেটাও দৃষ্টি বা শ্রবণের আড়ালে চলে যায়। আর ভারী ইঞ্চিনের ধাক্কা সহ্য করার মতো অবস্থা মানব শরীরের থাকে না। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মারা যান তারা, যদিও বা কেউ বাঁচেন, অঙ্গ হারা হয়ে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।
ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুশো বণিক বলেন, এই ধরনের মৃত্যু অনেকটাই আত্মহত্যার মতো। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বা কানে হেডফোন দিয়ে চলাচল করার কারণে ট্রেন আসছে কি না সেদিকে তাদের খেয়াল থাকে না। এসব বিষয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন হবে।
ঢাকা রেলওয়ে থানা কমলাপুর এর দেওয়া দেয়া তথ্য বলছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বছরে অন্তত ৩০০ মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। এর মধ্যে একটি বড় অংশের মৃত্যু ঘটে মোবাইল বা হেডফোনের অসতর্ক ব্যবহারে।
২০১০ ও ২০১১ সালে ২১ জন করে, ২০১২ সালে ৫২, ২০১৩ সালে ৬৭ জন, ২০১৪ সালে ১০৯ জন, ২০১৫ সালে ১০৩ জন মারা গেছে এ কারণে।
তবে পরের বছরগুলোতে ধীরে ধীরে মৃত্যু কিছুটা কমে এসেছে। ২০১৬ সালে ৩২ জন, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ৫৪ জন করে এবং ২০১৯ সালের গতকাল পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে হেডফোন বা মোবাইল ফোনের অসতর্ক ব্যবহারের কারণে।
একই সময়ে রেললাইনের ওপর বসা ও চলাচলের সময় ৭২৬ জন, রেলওয়ে ক্রসিং ও পারাপারের চেষ্টাকালে এক হাজার ২৬৮ জন ও ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ১৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সাত বছরে রেলওয়ের কেবল পূর্বাঞ্চলে (চট্টগ্রাম থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত) ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৪৯৯ জনের। অর্থাৎ বছরে এক হাজারের বেশি। আর পশ্চিমাঞ্চলেও (উত্তরাঞ্চল) মৃত্যু হয়েছে প্রায় সমসংখ্যক মানুষের। এর মধ্যে মোবাইল বা হেডফোনের কারণে মারা গেছে ১৫ শতাংশেরও বেশি।
রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোরশেদ আলম বলেন, মানুষকে নিজেদের সচেতন হতে হবে। সব মানুষকে বদলানো সম্ভব হবে না। আমরা সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছি।
মানুষের মধ্য আইন মানার প্রবণতা সৃষ্টি হতে হবে। তারা যদি নিজে থেকে সচেতন না হয় তবে সভা মিটিং আর ব্যানার ফেস্টুন লাগিয়ে লাভ হবে না। আর এই সচেতনতা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে।
সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক এ বিষয়ে বলেন, এই ধরনের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা বলা ঠিক হবে না। একজন মানুষ স্বেচ্ছায় কথা বলতে বলতে মৃত্যুর দিকে চলে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা।
আমাদের দেশের মানুষ এতো বেশি অসচেতন- এটা ভাবা যায় না। এসব বিষয়ে রেলওয়েরও আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। রেলওয়ের পাশে মানব বসতি একবারে আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।
রেল আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ এমনকি গবাদিপশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করা যায়। তবে বাস্তবতার কারণেই কাউকে এ জন্য আটকের উদাহরণ নেই।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *