পদ্মা সেতু গুজবের ভয়াবহতা বাড়ছে

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন সারাদেশ

গুজব গণপিটুনি বন্ধে সারাদেশের পুলিশকে বার্তা

এম এ স্বপন : পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ডালপালা মেলছে প্রতিদিনই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে ব্যাপকভাবে গণপিটুনির ঘটনা থামছে না। বরং তা বেড়েই চলেছে। শনিবার এক দিনেই অন্তত দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিন দিনে হত্যার ঘটনা ঘটেছে তিনটি। যার দুটি ঘটেছে রাজধানী ঢাকায় এবং একটি পাশের জনপদ নারায়ণগঞ্জে। এক লাখ মানুষের মাথা লাগবে বলে ছড়ানো উদ্ভট তথ্যে বিশ্বাস না করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি এসেছে এক সপ্তাহের বেশি হয়ে গেল। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বেশ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে। সে খবর এসেছে গণমাধ্যমেও। তবু তা কমছে না।
সারাদেশে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে-এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা বিষয়টির পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, এটাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন।
এর মধ্যে বুধবার নেত্রকোণা এবং পরদিন রাজশাহীতে ঘটা দুটি ঘটনা এই গুজবের আগুনে যেন ঘি ঢালে। নেত্রকোণায় এক শিশুকে কলাকেটে হত্যা করে ব্যাগে করে মাথা নিয়ে যাওয়ার সময় সন্দেহভাজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। আর এই খবর গণমাধ্যমে আসার পর নতুন করে শুরু হয় অপপ্রচার।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, পরদিন রাজশাহীতে নিজের ঘরে কাচের আঘাতে এক শিশুর গলায় আঘাত পাওয়ার পর এ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা-কল্পনা। শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তির পর পর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তার মাথা কেটে নেয়ার চেষ্টা হয়েছে।
বিভিন্ন এলাকায় তথ্য মিলেছে, অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে ইতস্তত করছেন। আবার তারা সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন যাওয়া ও ফেরার পথে।
এর মধ্যে অচেনা মানুষকে এলাকায় দেখলেই তেড়েফুঁড়ে আসছে স্থানীয়রা। আর একসঙ্গে বহু মানুষের প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেলেই শুরু হয় পিটুনি।
শনিবার সকালে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় এক নারীকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তফা কামাল জানান, উত্তর বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে সকাল সাড়ে আটটার সময় ওই নারীকে গণধোলাই দেয়। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসক সকাল সাড়ে ১০টার সময় তাকে মৃত ঘোষণা করে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঘটনা ঘটেছে দুটি। সকালে মিজমিজি আল আমিন নগর এলাকার সাত বছর বয়সী মেয়ে সাদিয়া স্কুলে যাচ্ছিল। এক যুবক তার সঙ্গে হাঁটছিলেন। এতে সন্দেহ হয় স্থানীয়দের। ওই যুবক জিজ্ঞাসাবাদে ‘অসংলগ্ন’ কথাবার্তা বললে জনতা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে গণপিটুনি দিলে ওই যুবক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পাইনাদী নতুন মহল্লার শাপলা চত্বর এলাকায় একটি বাড়িতে যান রেশমা নামের এক নারী। তিনি তিন বছরের শিশু নাদিমকে একটি পুতুল দেন। কিন্তু ওই নারীকে চিনতে পারছিলেন না বাড়ির বাসিন্দারা। সন্দেহ হলে বাড়িওয়ালাকে খবর দেয়। খবর পেয়ে বাড়ির সামনে জড়ো হয় জনতা। তারা ওই নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে পিএমএর মোড়ে আল বালাগ স্কুলে আটকে রাখে।
খবর পেয়ে পুলিশ ওই নারীকে উদ্ধার করতে গেলে উত্তেজিত জনতা তাকে নিতে দেয়নি। এ সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
এ ব্যাপারে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর শাহীন শাহ পারভেজ বলেন, সারা দেশে কারা এসব করছে কেন করছে আমি সেটাই ভাবছি। এসব গুজব থেকে বাঁচার জন্য ইতোমধ্যে এলাকায় মাইকিং করেছি। সেই মাইকে প্রচার করা হচ্ছে কাউকে সন্দেহ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের খবর দিন আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।
শুক্রবার রাতেও কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। অপরজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, রসুলপুর গ্রামে শরীফ মিয়ার বাড়ির সামনে দুই যুবক ঘোরাফেরা করতে থাকেন। এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাদের ঘোরাফেরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। দুই যুবক ঠিকঠাক উত্তর দিতে না পারায় এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে দুই যুবককে পিটুনি দেয়। এদের একজন মারা যান। একজন হন গুরুতর আহত।
এর আগে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে। একই এলাকায় পিটুনির ঘটনা ঘটেছে একাধিক। নারায়ণগঞ্জে ছেলে ও তার বন্ধুকে আনার সময় পেটানো হয়েছে বাবাকে। খুলনায় পেটানো হয়েছে মানসিক প্রতিবন্ধীকে।
গুজব গণপিটুনি বন্ধে সারাদেশের পুলিশকে বার্তা : শনিবার ঢাকার বাড্ডার এই বিদ্যালয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তসলিমা বেগম রেনু (৪২) নামে এক নারী মারা যান। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের মাথা লাগবে- এমন গুজব ডালপালা মেলে শেষে গিয়ে ঠেকেছে ছেলেধরার হাতে। ফলাফল হিসেবে-উদ্ভূত হয়েছে অদ্ভুত এক পরিস্থিতি, দেখা দিয়েছে ছেলেধরা আতঙ্ক। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে স্রেফ সন্দেহের বশে ঘটছে গণপিটুনির ঘটনা। সম্প্রতি কয়েকজন নিরীহ ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হওয়ায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বিষয়টা নিয়ে দৃশ্যত উদ্বিগ্ন পুলিশও। ছেলেধরার গুজব বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং ব্লগগুলো নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ছেলেধরা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিলে বা শেয়ার করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সোমবার পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-অপারেশন্স) সাঈদ তারিকুল হাসান সারাদেশের পুলিশের ইউনিটকে এই বার্তা পাঠান।
বার্তায় উল্লেখ করা হয়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছেলেধরা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক পোস্টে মন্তব্য বা গুজব ছড়ানোর পোস্টে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বার্তায় মোট চারটি উপায়ে ছেলেধরার গুজব ও গণপিটুনি প্রতিরোধে পুলিশের ইউনিটগুলোকে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, স্কুলে অভিভাবক ও গভর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়, ছুটির পর অভিভাবকরা যাতে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যায় সে বিষয়ে নিশ্চিত করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা, প্রতিটি স্কুলের ক্যাম্পাসের সামনে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, মেট্রোপলিটন ও জেলা শহরের বস্তিতে নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এছাড়াও বার্তায় গুজব বন্ধে জনসম্পৃক্ততামূলক কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে, উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গুজববিরোধী সচেতনতা সৃষ্টি, এলাকায় মাইকিং- লিফলেট বিতরণ, মসজিদের ইমামদের ছেলেধরা গুজববিরোধী আলোচনার নির্দেশনা।
এই চিঠির প্রেক্ষিতে পুলিশের কোন ইউনিট কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পুলিশ সদরদপ্তরে ফ্যাক্সের মাধ্যমে জানাতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, চিঠিতে গুজব বন্ধে পুলিশের ইউনিটগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশের পুলিশ সদস্যরা গুজব ও গণপিটুনি বন্ধে কাজ শুরু করেছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে ‘মানুষের মাথা লাগবে’ বলে সম্প্রতি ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়, যাতে বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
এরমধ্যে বৃহস্পতিবার নেত্রকোণা শহরে এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘শিশুর মাথা’ পাওয়ার পর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। এই ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।
পদ্মাসেতু নিয়ে গুজবের কারণে সারাদেশে এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ইমরানুল হাসান বলেন, আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। কারা এসব ছড়াচ্ছে, তাদের ওপর নজরদারি চলছে।
পুলিশও বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। শুক্রবার চাঁদপুর এলাকা থেকে সাজ্জাদ গাজী, সায়েম ভূইয়া এবং আবু খালেক রতন নামের তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়েছে।
চাঁদপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের না বুঝে মোবাইল থেকে শেয়ার করেছে বলে জানিয়েছে।
কুমিল্লার তিতাস এলাকা থেকে খোকন মিয়া নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে জেলা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট। খোকন মিয়া নামে ওই যুবক তার ফেসবুক আইডি থেকে ৭ ও ১০ জুলাই যথাক্রমে ‘মাথা কাটা থেকে সাবধান হুশিয়ার’ এবং ‘একটি বিশেষ সংবাদ’, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিতে পদ্মা সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে মানুষের মাথা খুব প্রয়োজন। তাই মানুষের মাথা কেটে নেয়া হচ্ছে’ শিরোনামে দুটি স্ট্যাটাস দেন।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, তার দেওয়া স্ট্যাটাস পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তিনি জানিয়েছেন, বিশ্বাসের জায়গা থেকে তিনি এসব শেয়ার করেছেন। অন্যরা করেছে তাই তিনিও করেছেন। এর পেছনে বা কোন স্বার্থগত কারণ পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নেহাল করিম বলেন, সরকার কী করছে, স্থানীয় সরকার কী করছে? প্রতিটি পাড়া মহল্লার ওয়ার্ড কাউন্সিলররা কী করছে? তাদের কাছে একটি একটি সার্টিফিকেট আনতে গেলেও টাকা দিতে হয়। তারা এলাকায় জনসচেতনা তৈরি করুক। আর যারা এসব গুজব ছড়াচ্ছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনুক। তাদের বিচারের মুখোমুখি করুক তাহলেই দেখবেন সব বন্ধ হয়েছে।
একই বিশ্ববিদ্যালয় নৃ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাইফুর রশীদ বলেন, এসব গুজব নতুন নয়। পদ্মা সেতু বলেন, আর যমুনা সেতুই বলেন, সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা বা রক্ত লাগবে- এসব কথা ছড়ানো হয়েছে। একটি সমাজ যখন উন্নতির দিকে যায় তখন একটি শ্রেণির মানুষ এটাকে মেনে নিতে পারে না। তারাই এ ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে থাকে।
আগেও আমাদের দেশের পোশাক কারখানাকে নিয়ে এমন প্রোপাগান্ডা ছড়াত। এখন দেখেন পোশাক কারখানায় কত হাজার মানুষ কাজ করে উন্নতি করছে।
এই গুজব থেকে মুক্তির উপায় কী- জানতে চাইলে অধ্যাপক সাইফুর বলেন, আমাদের শিক্ষা, সচেতনা ও প্রচার করে এসব থেকে বের হতে হবে। আর একজন মানুষ যখন প্রোপাগান্ডা করে করলেও তার বিচার না হয় তখন এসব আরো বাড়বে। আর যথাযথ বিচার হলে এসব কমবে।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *