নাড়ির টানে বাড়ির পানে

অন্যান্য এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন জীবনী ঢাকা সারাদেশ

বৃষ্টির সঙ্গে ট্রেনের বিলম্বে সীমাহীন ভোগান্তি
কমলাপুর থেকে চলছে ৩ জোড়া স্পেশাল ট্রেন
শিমুলিয়ায় সীমিত আকারে ফেরি চলাচল শুরু
অশান্ত নদীতে লঞ্চে যাবেন লক্ষাধিক মানুষ

মহসীন আহমেদ স্বপন : ঈদযাত্রার মূল স্রোত শুরু হয়েছে। গ্রামের পথে ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ। সরকার-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী অনেকেই ঈদের আগের শেষ কর্মদিবসে অফিসে হাজিরা দিয়েই বেড়িয়ে পড়েছেন বাড়ির পথে। সব মিলিয়ে রাজধানীর জনস্রোত এখন গাবতলী, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল; সদরঘাট নদীবন্দর আর কমলাপুর রেলস্টেশনে। এর মধ্যে শুরুতেই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে রেলে ঈদযাত্রায়। ঢাকা থেকে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে রওনা দিতে পারছে না।
বৃহস্পতিবার ভোরে বাস-ট্রেন-লঞ্চে করে পরিবার-পরিজন নিয়ে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে তারা। গত ৩০ জুলাই যারা ট্রেনের আগাম টিকিট ক্রয় করেছেন, তারাই বৃহস্পতিবার বাড়ি ফিরছেন। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের আগেই কমলাপুর স্টেশনে উপস্থিত হন যাত্রীরা।
সকালে কমলাপুর স্টেশনে এসে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে চাওয়া যাত্রীরা। বুধবার ট্রেনের কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল। তবে বৃহস্পতিবার ব্যাপক বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে ট্রেন।
অন্য ট্রেনগুলোরও বিলম্ব হবে বলে স্টেশন থেকে জানানো হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনগুলোর প্রতিটিই বিলম্বে ছেড়ে যাবে বলে স্টেশনে রাখা স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করেছে রাজধানী ঢাকা।
একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে ট্রেনের বিলম্ব। ফলে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা।
বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে রাজশাহীগামী ধুমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকাল ৬ টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও কমলাপুর ছেড়ে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে। চিলাহাটীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস সকাল ৮ টায় ছাড়ার কথা থাকলেও স্টেশনে রাখা স্ক্রিনে সম্ভাব্য সময় দেয়া হয় ১০ টা ২৫ মিনিট। বেলা ১১টায় এ ট্রেন ছাড়েনি। এ ছাড়া সকাল ৯ টার রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার সম্ভাব্য সময় দেয়া হয় সাড়ে ১০টায়, তবে বেলা ১১টা পর্যন্তও ছাড়েনি। দিনাজপুর-পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেস সকাল ১০ টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যাবে বলে জানানো হয়েছে।
চিলাহাটীগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী হাবিবুর রহমান বলেন, আজকের টিকিট সংগ্রহের জন্য গত ৩০ জুলাই ১৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকটা যুদ্ধ করে আজকের কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেয়েছিলাম, কিন্তু আজ সময়মতো স্টেশনে উপস্থিত হয়ে জানতে পারলাম ট্রেন আড়াই ঘণ্টা লেট। সঙ্গে মা, স্ত্রী, ছোট ছোট সন্তান রয়েছে। একে দীর্ঘপথ আমাদের যাত্রা করতে হবে, অন্যদিকে যদি ট্রেন এত লেট হয়, তাহলে এই বিড়ম্বনা কীভাবে মেনে নেয়া যায়। রেল কর্তৃপক্ষ জানেই যে, ঈদের সময় ব্যাপক যাত্রীর চাপ সৃষ্টি হয়। সে অনুযায়ী, তারা আগে থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। আর সেই মাশুল দিতে হয় আমাদের মতো সাধারণ যাত্রীদের।
রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী লাবণী আক্তার বলেন, রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেন সকাল ৯টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ১০ টাতেও ট্রেনটি আসেনি। আমার মতো হাজার হাজার মানুষ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। স্টেশনে বসে এভাবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা যাত্রীদের জন্য খুবই বিরক্তকর এবং বিড়ম্বনার। একবার টিকিট সংগ্রহের জন্য ১০-১২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানো, আবার সেই টিকিট অনুযায়ী ঈদযাত্রার সময় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়, এই বিষয়গুলো যে কতটা ভোগান্তির, তা শুধু আমাদের মতো যাত্রীরাই উপলব্ধি করতে পারে।
ঈদযাত্রার সার্বিক বিষয়ে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে সারা দিনে কমলাপুর স্টেশন থেকে ৩টি স্পেশালসহ মোট ৫৫টি ট্রেনে ছেড়ে যাবে। আমরা সার্বিক চেষ্টা করছি, ট্রেনগুলোর শিডিউল ঠিক রাখার। আসলে যে ট্রেনগুলো দেরি করে স্টেশনে এসে পৌঁছেছে, সেই ট্রেনগুলোই দেরিতে ছেড়েছে। বাকি ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়েই স্টেশন ছেড়ে গেছে।
কমলাপুর থেকে চলছে তিন জোড়া স্পেশাল ট্রেন : ঈদুল আজহায় রাজধানীর কমলাপুর থেকে চলছে তিন জোড়া স্পেশাল ট্রেন। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে তিন রুটে এ ট্রেন চলাচল। ঈদের আগে ও পরে চলবে এ ট্রেনগুলো। কমলাপুর থেকে যে তিন জোড়া স্পেশাল ট্রেন চলবে, তা হলো, দেওয়ানগঞ্জ ঈদ স্পেশাল, খুলনা ঈদ স্পেশাল ও লালমনি ঈদ স্পেশাল। রেলের তথ্য মতে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তিনটি স্পেশাল ট্রেনসহ মোট ৩৭টি আন্তঃনগর ট্রেন ছেড়ে যায়। আর বিভিন্ন রুটে ১৫টি মেইল ট্রেন চলবে। আন্তঃনগর ও মেইল মিলে প্রায় সাড়ে ৫৯ হাজার আসন রয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বাড়ি যান ঘরমুখো মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে ঈদুল আজহা উদযাপন করতে বাড়ি ফিরছেন। কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে কাজ করছি আমরা। এবার ট্রেন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সঠিক সময়ে ছেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া যাত্রীরা যাতে ডেঙ্গুজ¦রে আক্রান্ত না হন, এজন্য ট্রেনে এডিস মশা নিধনে ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ট্রেন যাত্রী ওবায়দুল হক বলেন, ভোরে বৃষ্টি থাকায় পরিবারকে নিয়ে কমলাপুর আসতে বেশ ভোগান্তি হয়েছে। গাড়ি পাওয়া যাচ্ছিলো না, পরে উবারে কমলাপুর পৌঁছালাম। অপর যাত্রী সাদিয়া বলেন, বাড়ি ফিরতে কিছুটা ভোগান্তি আছে, কিন্তু স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করলে সেই কষ্ট আর থাকে না। কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মোহাম্মদ আমিনুল হক বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কয়েক স্তরে একাধিক নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছে।
শিমুলিয়ায় সীমিত আকারে ফেরি চলাচল শুরু : প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া হয়ে কাঠালবাড়ির পথে পদ্মা পারাপারে সীমিত আকারে ফেরি চলাচল শুরু হয়েছে। তবে ঘাট এলাকায় এখনো কয়েকশ গাড়ি আটকে থাকায় বহু যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় চারটি ফেরির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথে লঞ্চ ও স্পিড বোটও চলাচল শুরু হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) আবদুল আলিম জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পদ্মায় ঢেউ একটু কমেছে। তাই সকাল থেকে ফেরি চলাচল শুরু করা হয়। তবে ১৫টি ফেরির মধ্যে রো রো ও কে-টাইপসহ মাত্র ৪টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ¯্রােতের তীব্রতা কমলে অন্য ফেরিগুলোও চলাচল শুরু করবে। মঙ্গলবার রাত থেকেই পদ্মায় প্রচ- ঢেউ ও তীব্র ¯্রােতের কারণে ফেরি পারাপার ব্যাহত হয়। গত বুধবার সকালের দিকে চারটি ফেরি চলাচল করলেও দুপুর থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। প্রবল ¯্রােতের মধ্যে নদীর পানি বাড়ায় শিমুলিয়া ৩ নম্বর ফেরিঘাট ডুবে গেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর আগে ১ ও ২ নং ফেরিঘাটের র‌্যাম সরে যায়। এতে নোঙর ছিঁড়ে ঘাটসংলগ্ন দুটি হোটেল ও আটটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ ও ২নং ফেরিঘাটের সংস্কার কাজ চলছে। আব্দুল আলিম বলেন, বৃহস্পতিবার সকালে ৩ নং ফেরিঘাটটি ঠিক করে সীমিত আকারে ফেরি সার্ভিস সচল করা হয়।
অশান্ত নদীতে লঞ্চে বাড়ি ফিরবেন লক্ষাধিক মানুষ : ভরা বর্ষায় অশান্ত নদীতে লঞ্চে করে এবারের ঈদে বাড়ি ফিরবেন দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ। নদীপথের ডুবোচর ও বালুবাহী বাল্কহেডগুলো লঞ্চমাস্টারদের চিন্তা বাড়াচ্ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ ও ওভারটেক না করার নির্দেশ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
ভরা বর্ষায় দেশের আকাশে সক্রিয় মৌসুমি বায়ু। ফলে এবারের ঈদে উত্তাল নদীতে তীব্র বাতাস আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে, নৌযানগুলোকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হবে।
স্বাভাবিক সময়ে নদীতে দিনে অনুমতি থাকলেও রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু বাল্কহেডগুলো এ আইন মানে না। সন্ধ্যা ও রাতে সদরঘাট থেকে লঞ্চগুলো ছেড়ে যাওয়ার সময়ও বাল্কহেডগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে।
ঈদে যাত্রীদের বাড়তি চাপের সুযোগ কাজে লাগাতে অনেক পুরনো ও ক্রুটিপূর্ণ লঞ্চ ঠিক কোরে রেখেছেন মালিকরা। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও প্রতি বছরই অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে লঞ্চগুলো সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। ভরা বর্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এবার দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেশি থাকায় লঞ্চগুলোকে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ।
এদিকে, সদরঘাট থেকেও ঈদের বিশেষ অতিরিক্ত লঞ্চযাত্রা শুরু হয়েছে। ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা নৌপথে স্বাভাবিক সময়ে ২১টি বেসরকারি লঞ্চ চলাচল করে। ঈদ সামনে রেখে এখন ট্রিপের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০টিরও বেশি। আর ঈদযাত্রায় শুধু এই রুটে দুই শতাধিক নৌযান চলাচল করবে। ঈদের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়তি লঞ্চের যাত্রীসেবা চালু থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে লঞ্চ মালিকদের আশঙ্কা, প্রবল স্রোতের টানে লঞ্চ নদীতে আটকা পড়ে কাৎ হয়ে যেতে পারে। এসব মোকাবেলায় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) প্রস্তুতি নেই।
অন্যদিকে সড়ক পথেও ঈদযাত্রার মূলস্রোত শুরু হয়েছে। গাবতলী, মহাখালী ও সায়দাবাদ টার্মিনাল থেকে সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে গেছে ঈদযাত্রার বিশেষ বাসগুলো। এখন পর্যন্ত বাসের শিডিউল বিপর্যয়ের কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়কের ৮০০ কিলোমিটারের অনেকাংশেরই সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় এবং পশুবাহী ট্রাকের বিশৃঙ্খল চলাচলের কারণে বিভিন্ন মহাসড়ক ও রাজধানীর সড়কগুলোর স্থানে স্থানে তীব্র যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যানজট শুরু হলে বেশিরভাগ রুটেই বাসগুলোও শিডিউল মেনে চলতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *