বালিশকান্ডের গোমড় ফাঁস

অপরাধ আইন ও আদালত এইমাত্র জাতীয়

বিশেষ প্রতিবেদক : টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আটক জি কে শামীমের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশ কেলেঙ্কারিতেও জি কে শামীমের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
গত শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর নিকেতনে তার ব্যবসায়িক কার্যালয় জি কে বিল্ডার্স থেকে শামীমকে আটক করে র‌্যাব। এ সময় সেখান থেকে টাকার পাহাড়ের সন্ধান পায় র‌্যাব। শুধু শামীমের মায়ের নামেই ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া যায়। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কী করে গড়লেন জি কে শামীম সেটি অনুসন্ধানে এখন একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্নীতিতে জি কে শামীম জড়িত বলে তথ্য প্রকাশ হয়। সেই ঘটনার বালিশকা-ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন জি কে শামীমই।
সূত্রের খবর, রূপপুরের গ্রিন সিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। সেখানে বড় অঙ্কের কয়েকটি কাজ জি কে শামীম নিজেই করছেন।
এছাড়া ৫ পার্সেন্ট কমিশনের বিনিময়ে ৩-৪টি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকটি কাজও দেন শামীম। মূলত রূপপুরের গ্রিন সিটি আবাসন পল্লী নির্মাণের প্রায় সব কাজই জি কে শামীমের দখলে ছিল।
তবে এদের মধ্যে যেসব কাজ পছন্দ হতো না সেগুলো অন্য ঠিকাদারদের দিয়ে দেন শামীম। তাও আবার মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে।
সূত্র জানায়, কমিশনের বিনিময়ে সাজিন ট্রেডার্স, এনডিই (ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লি.) ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বেশ কয়েকটি কাজ পাইয়ে দেন জি কে শামীম।
তার এই ব্যাপক কমিশন বাণিজ্যের কারণেই মূলত রূপপুরে ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে বালিশ, চাদর ও ইলেকট্রিক সামগ্রী সরবরাহে ব্যাপক দুর্নীতি হয়।
সাম্প্রতিক একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘটনায় শামীমের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জি কে বিপিএল ব্ল্যাকলিস্টেড হয়।
সেই প্রতিবেদনে জানা যায়, রূপপুরের গ্রিন সিটি আবাসন পল্লী নির্মাণ প্রকল্পে জিকে শামীমের এই আধিপত্যের নেপথ্যে ছিলেন পূর্ত মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। শামীমের প্রতিষ্ঠানকে বড় বড় কাজ পাইয়ে দিতেন তারা। সে বাবদ শামীম তাদের আলাদা কমিশন দিতেন।
মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তার বক্তব্য, এমনভাবে টেন্ডার আহ্বান করা হয়, যাতে শামীমের প্রতিষ্ঠানই কাজ পায়। টেন্ডারের শর্ত সেভাবেই নির্ধারণ করা হয়।
শামীমের সঙ্গে হাত মেলানো মন্ত্রণালয়ের সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সরকারি টেন্ডারের প্রাক্কলিত মূল্য বাড়িয়ে দেয়ার কাজটি করতেন। এর পর অতিরিক্ত মূল্যের একটি বড় অংশ অসৎ কর্মকর্তারা ভাগ করে নিতেন।
সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পাশে গ্রিন সিটি আবাসিক এলাকা নির্মাণ প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১৯টি ভবনের কাঠামো নির্মিত হয়েছে। আর এসব ভবন নির্মাণের জন্য কয়েকটি স্তরে ঘুষ দিতে হয়েছে। ওয়ার্ক অর্ডার পাওয়ার পর টেন্ডার মূল্যের ৫ পার্সেন্ট দিতে হয়েছে নেগোসিয়েশন খরচ বাবদ। আর এ পার্সেন্টেস নিয়েছেন জি কে শামীম। কারণ এই কাজ তিনিই সব কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এনেছেন বলে দাবি করেন।
জানা গেছে, গণপূর্তের সাবেক এক ইঞ্জিনিয়ার ১ পার্সেন্ট নিয়েছেন। সাবেক একজন মন্ত্রীকে দিতে হয়েছে ১ পার্সেন্ট, একজন সচিব নিয়েছেন পয়েন্ট ৫ পার্সেন্ট এবং পূর্ত অধিদফতরের একজন প্রকৌশলী নেন আরও পয়েন্ট ৫ পার্সেন্ট।
সূত্র বলছে, পূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজধানীতেও যেসব বড় বড় ভবন নির্মাণের কাজ হচ্ছে তার বেশির ভাগই নির্মাণ করছে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বিপিএল।
১০০ কোটি টাকার বেশি কাজ হলেই তা শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য বলে নির্ধারিত।
শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেসব কাজ করছে তার মধ্যে আছে দুটি ফেইজে নির্মিত জাতীয় রাজস্ব ভবনের ৫০০ কোটি টাকার কাজ, রাজধানীর আশকোনায় র‌্যাব সদর দফতর ভবন নির্মাণের ৪৫০ কোটি টাকার কাজ, ৪০০ কোটি টাকার পার্বত্য ভবন নির্মাণ, সচিবালয়ের কেবিনেট ভবন নির্মাণের ৩০০ কোটি টাকার কাজ।
পূর্ত মন্ত্রণালয়ে জি কে শামীমের এত আধিপত্যের কারণ হিসেবে জানা গেছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা।
মান্নান খানের আমলেই পূর্ত মন্ত্রণালয়ে বড় বড় সব টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ উপার্জন করেন শামীম। মান্নান খান যুগের অবসান হলেও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সঙ্গে খাতির রেখে জি কে শামীম পূর্ত মন্ত্রণালয়ে তার প্রভাব বজায় রাখেন। এবং আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *