জেব্রা ক্রসিংয়ে আতঙ্ক

অর্থনীতি এইমাত্র জাতীয় জীবন-যাপন

বিশেষ প্রতিবেদক : পথচারীদের নিরাপদ পারাপারের জন্য রাজধানীর বড় ও ব্যস্ত সড়কগুলোর কোনো কোনো মোড় ও সিগন্যাল পয়েন্টে জেব্রা ক্রসিং রয়েছে, আবার অনেক স্থানেই নেই। আরও বিভিন্ন সড়কের চিত্রও একই রকম। গুটি কয়েক মোড় ছাড়া বেশির ভাগ জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো সিগন্যাল কিংবা ট্রাফিক পুলিশ নেই। বিকল্প পারাপারের ব্যবস্থা না থাকায় এসব জেব্রা ক্রসিং পথচারীদের কাছে হয়ে উঠেছে আতঙ্ক।
রমনা মডেল থানার পশ্চিম পাশে মগবাজার-কাকরাইল মনসুর আলী সরণির সিগন্যালের জেব্রাক্রসিং সামনে রেখে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী দুই মেয়েসহ এক নারী। তাদের পাশে আরও দুজন কিশোর। তারা রাস্তা পার হয়ে ইস্কাটন গার্ডেন রোডে যাবেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও পার হতে পারছেন না তারা, বিরামহীন গাড়ির স্রোতে। দু-একজন একাধিকবার রাস্তায় নেমে আবার উঠে আসেন ফুটপাতে। পরে আরও কয়েকজন জড়ো হলে একসঙ্গে রাস্তায় নামেন তারা। কোনো গাড়ি থামে তো কোনো গাড়ি চলমান থাকে। ভয় নিয়েই গাড়ির ফাঁক গলে তারা উঠে আসে মাঝের আইল্যান্ডে। এবার সড়কের মগবাজারমুখী অংশ পেরোনোর পালা। সেখানেও একই কসরত করে বাকি অংশ পার হতে হয় তাদের।
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কটির এই মোড়ে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন হাজারো পথচারী সড়ক পারাপার করে। কিন্তু নিরাপদ পারাপারে সহযোগিতায় নেই ট্রাফিক পুলিশ। ট্রাফিক সিগন্যাল থাকলেও তা অকার্যকর। রাজধানীতে এ রকম অনিরাপদ জেব্রাক্রসিং রয়েছে অনেক।
বাংলামোটর থেকে হোটেল রূপসী বাংলার দিকে যেতে বাঁয়ে মোড় নিয়ে মিন্টু রোডে ঢোকার রাস্তা। বাঁয়ে মোড় বলেই এখানে অনবরত গাড়ির চাপ। এই মোড়ের মুখেই একটি জেব্রা ক্রসিং। এটি পার হতে গিয়ে অনেকের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। বাংলামোটর থেকে শাহবাগমুখী গাড়িগুলোর একটা অংশ হঠাৎই বাঁয়ে মোড় নিয়ে ধাওয়া দেয় পথচারীদের। রূপসী বাংলার পাশে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও এপারে কেউ নেই। ফলে চলমান গাড়ির সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই সড়ক পারাপার হচ্ছে পথচারীরা।
পথচারীদের নিরাপদ পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত হলেও তা অনেকটা অপরিকল্পিত বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আছে বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা। জেব্রা ক্রসিংকে গুরুত্ব দেন না চালকরা। তারা জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে গাড়ির গতি যেমন কমান না, তেমনি আবার যাত্রী তোলার জন্য জেব্রা ক্রসিং দখল করে গাড়ি থামান। কোথাও ট্রাফিক পুলিশের সামনে এমনটা ঘটছে; কোথাও ট্রাফিক পুলিশই নেই।
রাজধানীর সড়কগুলোতে পথচারীদের যত্রতত্র পারপার নিয়ে সমালোচনা কম নয়। কিন্তু নিরাপদ পারাপারের জন্য যেসব জেব্রা ক্রসিং রয়েছে, সেগুলো কতটা নিরাপদ?
পথচারীদের মতে, এসব জেব্রা ক্রসিংয়ে নিরাপত্তার চেয়ে ঝুঁকি বেশি। নিরাপদ পারাপারের জন্য দেয়া জেব্রা ক্রসিং হয়ে উঠছে বিপদের কারণ।
দুর্ঘটনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করতে পথচারীদের জন্য আলাদা ট্রাফিক সিগনালের ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন সেটি করা না যায়, দুর্ঘটনা এড়াতে জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে গতিরোধক স্থাপন করতে হবে।
নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ স্থানে জেব্রা ক্রসিং রাখা হয়েছে নিয়ম রক্ষার খাতিরে। তাও আবার কোথাও কোথাও ক্ষয়ে যাওয়ায় তা চোখে পড়ে না। জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে সতর্কতা সীমানার হলুদ দাগ অনেক স্থানে নেই। যেখানে এটি আছে সেখানেও চালকরা তা তোয়াক্কা করছেন না। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি রোধ করেন হলুদ দাগ ছাড়িয়ে জেব্রাক্রসিংয়ে।
কয়েকজন গাড়িচালকের সঙ্গে আলাপের সারর্মম হলো, তাদের অনেকে জানেন না হলুদ দাগের অর্থ। ট্রাফিক পুলিশ যেখানে হাত তোলেন সেখানেই গাড়ি থামান তারা। যেসব জেব্রা ক্রসিংয়ে ট্রাফিক পুলিশ কিংবা সিগনাল বাতি নেই, সেখানে পথচারীরা ইশারা না করলে গতি কমান না তারা।
এ রকম একটি ক্রসিং তাজউদ্দীন আহমদ সরণির নাবিস্কো মোড়। সরেজমিনে দেখা যায়, টিভিএস শো-রুমের সামনের এই জেব্রা ক্রসিংটির ব্যবহার অনেক বেশি। স্থানীয়রা জানান, প্রতি মিনিটে গড়ে ১০ জন পথচারী এটি ব্যবহার করেন। কিন্তু জেব্রা ক্রসিং থাকার পরেও সেখানে গাড়ি থামার চিত্র বিরল। হাত দিয়ে ইশারা করে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পারাপার হতে হয় পথচারীদের। বোঝাবুঝির ভুল হলেই দুর্ঘটনা।
স্থানীয় রিকশাচালক মহিবুল্লাহ বলেন, হাত দেখাইলেই কি আর সবাই গাড়ি থামায়? সবাই তাড়াতাড়ি যাইতে চায়। অনেকেই দেহা যায়, হাত দেখাইয়া রাস্তা পার হইতে গেছে, ভাবছে গাড়ি থামব, কিন্তু থামে নাই। তখন একসিডেন্ট হয়।
পথচারী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, এগুলো জেব্রা ক্রসিং না, মানুষ মারার ফাঁদ পাতা হয়েছে। গাড়ি চলছে, মানুষ পার হচ্ছে। আশপাশে কোনো ফুটওভার ব্রিজও নাই যে সেখান দিয়ে পার হব।
রাজধানীর প্রগতি সরণিতে শিক্ষার্থী আবরারের নিহত হওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে এই পথচারী বলেন, এ দেশে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু হয় না, যতক্ষণ না কেউ নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে হুঁশ করবে। এখানে কেউ জীবন দিবে, আন্দোলন হবে। তারপর এই সমস্যারও সমাধান হবে।
এমন ঝুকিপূর্ণ জেব্রা ক্রসিং দেখা গেছে মিরপুর রোডের মানিক মিয়া এভিনিউর বিপরীতে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সামনে। শ্যামলী থেকে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের প্রবেশমুখে কোনো সিগনাল পয়েন্ট নেই। ফলে একের পর এক গাড়ি প্রবেশ করছে মানিক মিয়া এভিনিউতে। সেসব চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপারে বাধ্য হচ্ছেন শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষ।
পথচারী মিজানুর রহমান বলেন, জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামার কথা। কিন্তু থামে না, বরং গাড়ি চলছে আমরা থেমে থাকি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে পরে বাধ্য দিয়ে গাড়ির সামনে দিয়েই রাস্তা পার হতে হয়।
আবার এখানে জেব্রা ক্রসিং কেন দেয়া হয়েছে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মনে। স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, আসাদগেট মোড়ের সাথে ফুটওভার ব্রিজ আছে। রাস্তা তো সেখান থেকে পার হলেই হয়। এখানে কেন জেব্রা ক্রসিং দিতে হবে? আর কেনই বা পারাপার হতে হবে?
এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ জেব্রা ক্রসিং দেখা গেছে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোড, শংকর বাসস্ট্যান্ড, শ্যামলী শিশু মেলার পশ্চিম পাশে।
রাজধানীর সড়কে জেব্রাক্রসিং স্থাপনে ত্রুটির কথা বলরেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেটি আদর্শ সেটি হলো, জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে পথচারীদের জন্য একটি সিগনাল থাকবে। আমাদের দেশে সেটি নেই।
এ থেকে উত্তরণের পথও দেখান এই দুর্ঘটনা বিশ্লেষক। বলেন, দুটি কাজ করা যেতে পারে, একটি হলো পথচারীদের আলাদা একটি সিগনাল পদ্ধতি বা অল-রেড সিগনালের ব্যবস্থা করা। অথবা জেব্রা ক্রসিংয়ের আগে গতিরোধকের ব্যবস্থা


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *