
নিজস্ব প্রতিবেদক : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কঠোর নির্দেশনা জেনেশুনেই অমান্য করে জব্দ করা ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা গায়েব—এ যেন বাংলাদেশে দুর্নীতির নতুন সংজ্ঞা! আর এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ আলম, যাকে সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত প্রশাসনিক মহল।

অর্থ পাচারের শঙ্কা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন—কোনো কিছুই মাসুদ আলমের বেপরোয়া দাপটকে থামাতে পারেনি। বরং জব্দ হওয়া হিসাব থেকেই কোটি কোটি টাকা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় রহস্যজনকভাবে উত্তোলন হয়ে যায়। এই ঘটনায় ব্যাংক থেকে প্রশাসন—সবার মাথায় হাত।
৪৮ কোটি টাকার বিল, তারপরই ‘গায়েবি লেনদেন’ : যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় দুই ধাপে মোট ৪৮ কোটি টাকা জমা হয় মাসুদের প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে। প্রতিটি ধাপে ২৪ কোটি করে বিল। কিন্তু যখন লেনদেন সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়, দুদক ও বিএফআইইউ মাসুদ, তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করে দেয়।

কিন্তু তাতেই শেষ নয়।

অভিযোগ অনুযায়ী, ৩০ জুন, ৩০ সেপ্টেম্বর, এই দুই তারিখে ‘জমাকৃত বিল’ দেখিয়ে কৌশলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়—যা ফ্রিজ অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলনের রীতিমত দুর্লভ উদাহরণ।
এতেই থেমে থাকেনি বেপরোয়া লেনদেন। অভিযোগ আরও ভয়াবহ—উত্তোলিত অর্থের বড় অংশ সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং বর্তমানে কারাগারে থাকা সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিনের কাছে পাচার করা হয়।
সিআর মামলা, বিশেষ ক্ষমতা আইন—সব মিলিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ : ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই দায়ের হয়েছে সিআর মামলা নং–৪৯৯/২০২৫ এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৪৮, ৩২৬, ৩০৭, ১১৪ ও ১০৯ ধারা, সঙ্গে বিশেষ ক্ষমতা আইন।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন— “জব্দ করা ব্যাংক হিসাব থেকে এমন উত্তোলন—বাংলাদেশে প্রায় শোনা যায় না।” প্রশাসনিক মহলেও এখন প্রশ্ন—এত বড় কাণ্ড ঘটানোর সাহস মাসুদ পেল কোথা থেকে?
৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পে ১০ কোটি টাকা ঘুষ: তদন্তে আরেক বিস্ফোরণ : তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও ভয়ংকর তথ্য। মাসুদ আলম নাকি ৩০০ কোটি টাকার একটি সরকারি প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ঘুষ দিয়েছেন—তখনকার ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রায় ১০ কোটি টাকা, প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ খানও পেয়েছেন অনৈতিক সুবিধা।
আইটি খাতের পর্যবেক্ষকরা বলছেন— “এই প্রতিষ্ঠান প্রকল্প পাওয়ার যোগ্য ছিল না। রাজনৈতিক তদবির আর ঘুষ ছাড়া এদের এমন প্রকল্প পাওয়া অসম্ভব।”
ছাত্রলীগ রাজনীতি, ৭০টি মামলা, গণহত্যার অভিযোগ—মাসুদের অতীতও রক্তাক্ত ইতিহাস : মাসুদ আলমের অতীতও সমান বিতর্কিত। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তার বিরুদ্ধে আছে— উসকানি, হত্যা, সরকারি সম্পদ ধ্বংস, প্রায় ৭০টি মামলা এবং এমনকি গণহত্যার মতো অভিযোগেও নাম। তবু নতুন সরকারেও তার প্রতিষ্ঠান প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিল—যা প্রশাসনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
এমএলএম প্রতারণা থেকে ১৫ কোম্পানি—‘প্রমিস গ্রুপ’ নামের সাম্রাজ্য : মাসুদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যও রহস্যে ভরা। তিনি একসময় ‘নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে এমএলএম ব্যবসায় হাজারো মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। পরে নাম পাল্টে গড়ে তোলেন— প্রমিস মার্ট, প্রমিস অ্যাসেট, প্রমিস টেক, আরও প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান দুদকের ধারণা—এগুলি ছিল মানিলন্ডারিং ও অবৈধ সম্পদ সাদা করার খাঁচা।
হলফনামায় ৯.৯৫ কোটি—কিন্তু প্রকৃত সম্পদ কোথায় ?২০২৪ সালে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় হলফনামায় দেখিয়েছেন— মোট সম্পদ: ৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং বার্ষিক আয়: মাত্র ২১ লাখ।কিন্তু দুদকের মতে— প্রকৃত সম্পদ এর কয়েকগুণ বেশি। বেশিরভাগ সম্পদই গোপন রাখা হয়েছে।
বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা, সব ব্যাংককে তথ্য দিতে নির্দেশ :
দুদক এখন মাসুদ ও তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রা নিষিদ্ধ করেছে।
দেশের— সব ব্যাংক, সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের সম্পদের সম্পূর্ণ তালিকা জমা দিতে। প্রমিস গ্রুপের কর্মকর্তারাও নজরদারিতে।
সরেজমিনে: প্রতিষ্ঠান বন্ধ, ফোন বন্ধ—দুর্নীতির দুর্গে নীরবতা : সরেজমিনে দেখা গেছে—’ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড’-এর সব অফিস কার্যক্রম বন্ধ। ফোন নম্বরগুলো বন্ধ। কার্যালয় কার্যত অচল। আইটি খাতের সংশ্লিষ্টরা বলেন— “এদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই ভুয়া বিল, নিম্নমানের প্রশিক্ষণ, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল।”
ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ: কিভাবে হল ‘অসম্ভব’ উত্তোলন ? দুদক ও বিএফআইইউ এখন ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। মূল প্রশ্ন—জব্দ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারলে, তাহলে আর্থিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌ কাজ করছে কি? সত্যতা মিললে ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সকলে আইনের মুখোমুখি হবে।
রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপারেশন ‘১০০ কোটি’ ? তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন— “রাজনৈতিক সুরক্ষা ছাড়া এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।” প্রশাসন, ব্যাংক এবং আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ভেতরকার অসাধু অংশকে ব্যবহার করে মাসুদ আলম কিভাবে অপারেশনটি সফল করলেন—এটাই এখন তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু।
অর্থনীতির জন্য হুমকি, দুর্নীতির নতুন অধ্যায় : অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে— এই ঘটনা দেশের:, আর্থিক নিরাপত্তা কাঠামো, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা, সবকিছুর জন্য বিপজ্জনক। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ এমনভাবে গায়েব হওয়া শুধু দুর্নীতি নয়—এটি রাষ্ট্রের প্রতি আস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি আঘাত।
শেষ কথা : মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত এখন কেবল একজন ব্যক্তির দুর্নীতির গল্প নয়—এটি রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতার এক ভয়ঙ্কর আইনা। দুদক ও বিএফআইইউর তদন্ত শেষ হলে এ ঘটনা বাংলাদেশের দুর্নীতি চিত্রে সবচেয়ে বড় নজির হয়ে দাঁড়াতে পারে।
