ই-কমার্স নীতিমালা প্রসঙ্গে

অর্থনীতি

নিজস্ব প্রতিনিধি : পৃথিবীব্যাপী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু সাধারণ নীতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১. ব্যবসার অনুমতির জন্য লাইসেন্স সংগ্রহ করা, ২. শিপিং ও ডেলিভারি পলিসি, ৩. রিফান্ড পলিসি, ৪. অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য নিশ্চিতকরণ, ৫. ক্রেতাদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা প্রদান, ৬. বয়স ও লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ, ৭. কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের সীমা, ৮. মৌলিক ব্যবসায়িক নীতি মেনে চলা। কোনো একটি কোম্পানি বা প্লাটফর্মকে ই-কমার্স হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য উল্লিখিত মৌলিক সব বিষয় মেনে চলতে হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে বিদ্যমান অধিকাংশ অনলাইন প্লাটফর্মকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বলা যায় না! তবে যেহেতু ই-কমার্সের জন্য দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, সেহেতু উল্লিখিত শর্তগুলোর কয়েকটি বা আংশিক মেনে নিয়ে কেউ কেউ নিজেদের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাবি করছেন। অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ই-কমার্সের ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করতে এসব সাধারণ নীতি মেনে ব্যবসা পরিচালনা করার বিকল্প কিছু নেই। বর্তমানে দেশে অনলাইন ব্যবসা নিয়ে যে বিতর্ক, অনিশ্চয়তা আর আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ই-কমার্সের মৌলিক নীতিগুলো অনুসরণ না করা। যে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ঘিরে বিতর্ক, তাদের ব্যবসার মডেল পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে জানা যায় না। ভিন্ন কিছু ব্যবসায়িক কৌশল একই সূত্রে গেঁথে অনন্য একটি ই-কমার্স মডেল তৈরি করেছে তারা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটি ই-কমার্সের মৌলিক নীতিগুলো মানছে না।


বিজ্ঞাপন

সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১’ চূড়ান্ত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে ভেটিংয়ের জন্য নির্দেশিকাটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এখন দেখার বিষয় কত সময়ের মধ্যে সে নির্দেশিকা বাস্তবায়ন হয় কিংবা ক্রেতা ও উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে কী থাকে সে নির্দেশিকায়। এরই মধ্যে জানা গেছে, অগ্রিম নেয়ার পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করার বাধ্যবাধকতা থাকছে সেটিতে। এটি ভালো উদ্যোগ, ই-কমার্স নির্দেশিকায় কোন বিষয়গুলো থাকা জরুরি, সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই।

ই-কমার্স প্লাটফর্মের জন্য জরুরি বিষয় হচ্ছে শিপিং, ডেলিভারি ও রিফান্ড পলিসি। একটি পণ্য রিটেইলার বা উৎপাদকের কাছ থেকে ডেলিভারি পর্যন্ত পরিবহনসহ পুরো প্রক্রিয়া শিপিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। অর্ডারকৃত পণ্যের শিপিং কীভাবে, কাদের মাধ্যমে করা হবে তা সুনির্দিষ্ট থাকতে হয়। কারণ এটি না হলে যে চ্যানেলে বা যাদের মাধ্যমে শিপিং করা হবে, সেটির ক্রেতার কাছে বিশ্বস্ত কিনা, তা দেখার সুযোগ থাকে না। আর সঠিক ডেলিভারির জন্য শিপিং গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ডেলিভারির সুনির্দিষ্ট সময় ক্রেতাকে জানানো আবশ্যক। আর কোম্পানি যদি সঠিক সময়ে অর্ডারকৃত পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হয় বা পণ্যে কোনো ত্রুটি থাকে, সেক্ষেত্রে রিফান্ড পলিসিটি পূর্বনির্ধারিত থাকা আবশ্যক। শিপিং, ডেলিভারি এবং রিফান্ড—এ তিনটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অধিকাংশ ই-কমার্স কোম্পানি ব্যর্থতা থেকে বের হতে পারছে না। শিপিং, ডেলিভারি ও রিফান্ডের ক্ষেত্রে কিছু কোম্পানি দিন দিন উন্নতি করলেও কিছু কোম্পানির বিষয়ে ক্রেতাদের অভিযোগের শেষ নেই। অভিযোগগুলোর মধ্যে নির্ধারিত সময়ে অর্ডারকৃত পণ্য শিপিং ও ডেলিভারি না করা, অনলাইনে পণ্যের শিপিং স্ট্যাটাসের সঙ্গে বাস্তবতার অমিল এবং রিফান্ড করার ক্ষেত্রে গ্রাহক হয়রানি অন্যতম। এসব বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে প্রতিকার চাওয়া হলেও নীতিমালার অভাবে কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়নি। ই-কমার্স প্লাটফর্মে বিক্রির জন্য প্রদর্শিত পণ্যের যাবতীয় তথ্য প্রদান করা আরেকটি জরুরি বিষয়। পণ্যের অরিজিন ও জেনেরিক নাম, উপাদান, উৎপাদকের নাম-ঠিকানা, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ইত্যাদি প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করা উচিত। এর গুরুত্ব অনুভব করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সরকার সম্প্রতি এ বিষয়ে নতুন একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বাংলাদেশে অনলাইন প্লাটফর্মে পণ্যের আংশিক তথ্য দেখা যায়। খুব কম পণ্যের ক্ষেত্রেই জেনেরিক নাম ও মেয়াদ উল্লেখ করা হয়।

ক্রেতাদের তথ্যের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিষয়ে তেমন কোনো সংকট এখনো পরিলক্ষিত হয়নি দেশে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে বয়স ও লিঙ্গসমতার বিষয়টি মানা হচ্ছে না ঠিকভাবে। পৃথিবীর জনপ্রিয় ও সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কোনো পণ্যের উপস্থাপন বা বিজ্ঞাপন বয়স ও জেন্ডারভেদে যাতে কারো জন্য অস্বস্তির কারণ না হয়, সেটি খেয়াল রাখা হয়।

টেকসই ব্যবসায় এবং ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কোম্পানির সম্পদ ও দায়ের অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে এটি আরো জরুরি বিষয়। কারণ এতে পণ্যের উৎপাদক বা সরবরাহকারী এবং ভোক্তারা সরাসরি অংশীজন। কোম্পানির সম্পদের তুলনায় দায় অধিক হারে বেড়ে গেলে একদিকে উৎপাদক বা সরবরাহকারীকে তাদের পাওনা সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে দেয়া সম্ভব হয় না, অন্যদিকে সঠিক সময়ে মানসম্মত পণ্যটি পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। আর কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানই দীর্ঘ সময় ক্ষতি নিয়ে চলতে পারে না।

সম্প্রতি দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে আলোচিত এক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের যে পরিমাণ চলতি সম্পদ রয়েছে, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গ্রাহকদের পাওনার মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিশোধ করতে সক্ষম। বিষয়টি শুধু উদ্বেগজনকই নয়, যেকোনো ব্যবসায় নীতির পরিপন্থীও বটে। প্রতিবেদনে আরো বলা আছে, গ্রাহকদের কাছ থেকে কোম্পানিটি ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা অগ্রিম গ্রহণ করে।