রাষ্ট্রীয় জ্বালানি খাতে ‘সমান্তরাল সাম্রাজ্য’ : ডিএম সাঈদুল রহমানের নিষিদ্ধ সংগঠনের কানেকশন ও রিভার অয়েলে তেলচুরির ভয়াবহ সিন্ডিকেট

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ অর্থনীতি আইন ও আদালত চট্টগ্রাম জাতীয় ঢাকা বানিজ্য বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

!! বছরে অন্তত ৬০০ কোটি টাকার তেল গায়েব—অভিযোগের কেন্দ্রে এক ব্যক্তি!!  ব্যাংক লেনদেনে রহস্য: কোথা থেকে এলো ৪৮১ কোটি টাকার উৎসবিহীন নগদ প্রবাহ? !!  পলাতক শক্তির তত্ত্বাবধায়ক, আমলাদের ‘ম্যানেজার’, কর্মকর্তাদের আতঙ্ক—সাঈদুল রহমান কে?


বিজ্ঞাপন

নিজস্ব প্রতিবেদক : নিষিদ্ধ সংগঠন সমুদ্র যুব ঐক্য পরিষদ–এর প্রভাবশালী সভাপতি আজিম উদ্দিন ছিলেন বন্দরনগরী পূর্বচরের আন্ডারওয়ার্ল্ড রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। ক্ষমতার চূড়ায় থাকা অবস্থায় তিনি যে ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি ‘সুরক্ষা-বলয়’ তৈরি করে দিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন তার শ্যালক— রিভার অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজার (অপারেশন) সাঈদুল রহমান।

আজিম উদ্দিন এখন ভারতে পলাতক। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—তার প্রভাব ও অর্থের লাইনটি এখনো অক্ষত। আর এই লাইনটির বাংলাদেশ প্রান্তের নিয়ন্ত্রক হিসেবে একাই পুরোটা সামলাচ্ছেন সাঈদুল।


বিজ্ঞাপন

রিভার অয়েলে তেলচোরদের “দুর্গ”—পতেঙ্গা টার্মিনাল : যেখানে ১% তেল কম দেখানো মানেই দিনে ৮–১২ কোটি টাকার ‘লিকেজ’ এবং এই সেকশনেই টানা তিন দশক কর্তৃত্ব সাঈদুলের :


বিজ্ঞাপন

রিভার অয়েলের পতেঙ্গা টার্মিনাল—দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জ্বালানি লোডিং-ডিপো। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৭,০০০–৮,২০০ মেট্রিক টন ডিজেল, অকটেন ও পেট্রল স্থানান্তর হয়।

বিশেষজ্ঞদের হিসাব : মাত্র ১% লুকানো বা কম দেখালে,  দৈনিক ক্ষতি: ৮.২–১০ কোটি টাকা, মাসিক ক্ষতি: ২৪০–৩০০ কোটি টাকা এবং বার্ষিক ক্ষতি: ৩,০০০+ কোটি টাকা।

এই সেকশনেই সাঈদুল রহমানের স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ। ১৯৯৭ সালে স্থায়ী হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যও টার্মিনালের বাইরে পূর্ণাবধি বদলি হয়নি। অফিস বদলির আদেশ হলেও “পাঁচ মিনিটেই বাতিল” হয়েছে—এমন তথ্য একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এই দীর্ঘ দিনের প্রভাবের কারণেই “টার্মিনালে কীভাবে, কখন, কত তেল ঢোকে—আর কত বের হয়” এসবের প্রতিটি নথিই তার নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং আছে।

সিন্ডিকেটের মডাস অপারেন্ডি—অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ ৮ ধাপের চুরি কৌশল :  ভুয়া লোডশিট তৈরি, বাহিরের ডিজেল-ট্যাংকারে অতিরিক্ত গোপন চেম্বার, তেল উত্তোলনের সময় মিটার কম দেখানো,  ল্যাব টেস্টে গ্রেড কম দেখিয়ে ‘অতিরিক্ত অংশ’ গায়েব, রাতের শিফটে ট্যাংকারের গন্তব্য পাল্টানো,  টার্মিনাল–পাম্পের মাঝপথে আংশিক আনলোড এবং  চেকপোস্টে পুলিশ ‘ম্যানেজ’, দিন শেষে নথি ‘রি-জাস্টিফাই’ এই পুরো নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে একজনই—ডিএম সাঈদুল রহমান।

রিভার অয়েলের এক ডেপুটি কন্ট্রোলার মন্তব্য করেছেন— “টার্মিনালের এক লাইন মিটার নষ্ট হলে আমরা জানতাম না, কিন্তু সাঈদুল জানতেন কোন মিনিটে, কে করেছে এবং কেন।”

 এটা কি শুধুই দক্ষতা? নাকি গভীরতর স্বার্থ? ব্যাংকে রহস্যজনক টাকা—উৎসবিহীন লেনদেন ৪৮১ কোটি ৬০ লাখ টাকা : গত এক বছরে সাঈদুল এবং তার স্ত্রীর নামে থাকা ৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট লেনদেন পাওয়া গেছে— ৳ ৪৮১,৬০,০০,০০০ (চারশ’ একাশ কোটি ষাট লাখ টাকা)।

ব্যাংকভেদে লেনদেন৷  : সিটি ক্রেডিট ব্যাংক — ৮৭ কোটি, গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ ব্যাংক — ৬২ কোটি , ইস্ট ওয়েস্ট ট্রাস্ট ব্যাংক — ৫৫ কোটি, সাউথ এশিয়া ফিন্যান্স — ৭৬ কোটি, হিল ভিউ ব্যাংক — ৪৩ কোটি, সিকিউরিটি ট্রেড ব্যাংক — ৯৭ কোটি এবং  ইউনিয়ন প্রাইম ব্যাংক — ৬১ কোটি, লেনদেনের ৬৫%ই ক্যাশ উত্তোলন, যা ব্যাংক আইন অনুযায়ী ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেন’। অপরদিকে ১৮ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর হয়ে কানাডায় গিয়েছে—পুত্র–কন্যার নামে।

পলাতক আজিম উদ্দিনের নেটওয়ার্ককে আশ্রয়—কাসালগঞ্জ ভবন এখন “নিরাপদ ঘাঁটি” : কাসালগঞ্জের ৭৭৫/৮৮৫ নম্বর ‘আরিজ হাউজ’ নামের ভবনটিতে—অন্তত ৯ জন পলাতক সদস্য, দলের ৩ জন অস্ত্রধারী, এবং ২ জন বিদেশফেরত ‘ফান্ড হোল্ডার’ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেয়ার দায়িত্বও সাঈদুলের। স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন—“মাসে একদিন করে ২টি প্রাইভেট গাড়ি আসে। ব্যাগ বদলায়।আমরা জানি না কী আছে।” এখন পর্যন্ত কোনো সংস্থা তল্লাশিই চালায়নি।

সম্পদ কেলেঙ্কারি—সরকারি চাকরি করে প্রায় অর্ধ-হাজার কোটি টাকার মালিক, কাসালগঞ্জে পাঁচতলা বাড়ি ‘আরিজ হাউজ’
বাজার মূল্য আজ ১০–১২ কোটি টাকা, আট শতাংশ জমিতে ১০-তলা ভবন নির্মাণাধীন, প্রকল্প মূল্য: ৩০–৩৫ কোটি টাকা, গ্রামে পাঁচ ভাইকে পাঁচটি বাড়ি নির্মাণ এর আনুমানিক ব্যয় : ১৫ কোটি টাকা, বিদেশে ৩টি ফ্ল্যাট, কানাডা, মালয়েশিয়া, ভারত, মূল্য মোট: প্রায় ৫০–৬০ কোটি টাকা। গাড়ির বহর, প্রিমিও হ্যাভেল জিপ, অফিসিয়াল গাড়ি নিয়েও ব্যক্তিগত ব্যবহার, মোট আনুমানিক সম্পদ: ৪৮০–৫২০ কোটি টাকা।

তিন সংস্থাই নীরব—কেন?  জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রিভার পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এর  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিন সংস্থার কর্মকর্তাদের মুখেই একই কথা—“উপরে থেকে চাপ আছে, ফাইল খোলা যাবে না।”সূ ত্র বলছে—দুদক–এর একাধিক কর্মকর্তার সাথেও “লেনদেন” হয়েছে। এমনকি তদন্ত শুরুর প্রস্তাব উঠতেই নির্দিষ্ট কিছু অফিসারকে তড়িঘড়ি করে বদলি করা হয়।

একজন জ্যেষ্ঠ আমলা মন্তব্য করেন— “যেখানে তিনটি সংস্থাই চুপ, বুঝতে হবে কেউ না কেউ খুব শক্তিশালী তাকে রক্ষা করছে।”

রিভার অয়েলের ভেতরে আতঙ্ক—‘নীরবতা মানে চাকরি বাঁচানো’ :  কর্মকর্তাদের মতে— যে সাঈদুলের বিরুদ্ধে মুখ খোলে→ তারই বদলি হয় পাহাড়ি জেলায়। যে কোনো নথি প্রকাশ করে→ পরদিনই শোকজ। অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব→ দুইবারই ‘অজ্ঞাত কারণে’ বাতিল।

এক কর্মকর্তা বলেন—“টার্মিনাল অফিসে সবাই জানে—এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এটা সাঈদুলের প্রাইভেট সাম্রাজ্য।”

উপসংহার : রাষ্ট্রীয় জ্বালানি খাতের অন্ধকার—কবে শুরু হবে প্রকৃত তদন্ত?  যেখানে হাজার কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আর এক ব্যক্তি তিন দশক ধরে সেই প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সেকশন নিয়ন্ত্রণ করছে—তখন প্রশ্নই ওঠে,

রাষ্ট্র কি এই সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা রাখে? নাকি আমলাতন্ত্র, পুরনো রাজনৈতিক শক্তি এবং লুকানো অর্থের বৃত্তই রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে?

ডিএম সাঈদুল রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখন পরিণত হয়েছে “পাহাড়ে”—কিন্তু তদন্ত ফাইল এখনো খোলা হয়নি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের হিসাব কে দেবে?  জনগণের সম্পদের রক্ষকই যখন লুটের প্রধান পরিকল্পনাকারী—তখন অপরাধ কে ধরবে?

👁️ 34 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *