
বিশেষ প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ার—যা একসময় ছিল পেশাগত সততা ও মর্যাদার প্রতীক—আজ সেই চেয়ারের চারপাশেই ঘুরছে ভয়ঙ্কর এক অদৃশ্য ক্ষমতার ছায়া। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মো. খালেকুজ্জামান চৌধুরী যেন ধীরে ধীরে আটকা পড়ছেন সাভার গণপূর্ত সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম খানের প্রভাববলয়ে।

অস্ট্রেলিয়ায় উচ্চশিক্ষা—ক্যারিয়ারে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি—আর দীর্ঘ প্রত্যাশার পর প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পাওয়া খালেকুজ্জামানকে গণপূর্ত পরিবার একটি ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবেই দেখছিল। কিন্তু কয়েক মাসেই সেই আস্থার স্তম্ভে পড়েছে তীব্র ধাক্কা। অভিযোগ, বদরুলের “নানা বদকর্মে” ডুবে যাচ্ছে প্রধান প্রকৌশলীর নবগঠিত নেতৃত্ব ও পুরা অধিদপ্তরের প্রশাসনিক স্থিতি।
ক্ষমতার মোড়ল বদরুল—বদলে যাওয়া মুখোশের পিছনে লুকানো শক্তি : অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগেই বদরুল আলম ছিলেন সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ বলয়ে। তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর এলাকার লোক হিসেবে পরিচিত হয়ে তিনি নিয়োগ–বদলি–টেন্ডার—সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করতেন।

ভোলায় নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে—যা তাঁকে আরও বেপরোয়া করে তোলে বলে সহকর্মীদের অভিযোগ।

কিন্তু ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির পরিবর্তনে বদরুলের আচরণও নাকি পাল্টে যায়। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, তিনি নিজেকে নতুন সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, কৌশলে দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, এবং দ্রুতই বর্তমান সচিব মো. নজরুল ইসলামের নিকটমহলে জায়গা করে নেন। ওই পরিচয়ের জোরেই নাকি তিনি পুনরায় ‘অদৃশ্য কর্তৃত্ব’ কায়েম করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে।
খালেকুজ্জামানের দায়িত্ব নেওয়া—আর সেই মুহূর্তেই বদরুলের উত্থান : গত ২৮ অক্টোবর হঠাৎ করে পূর্বের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় খালেকুজ্জামানকে। পাঁচজনকে ডিঙিয়ে (সুপারসিড করে) এই নিয়োগ অনেকের নজরে সন্দেহ জাগায়। আর ঠিক দায়িত্ব নেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অভিযোগ, “বদরুলের কৌশলে নতুন প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ–বদলিসহ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নরম হয়ে পড়েছেন।”
গণপূর্তের বহু কর্মকর্তা বলছেন— “খালেকুজ্জামান বিদেশে ছিলেন, অভ্যন্তরীণ সিন্ডিকেট সম্পর্কে জানতেন না। সেই সুযোগেই বদরুল তাঁকে নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলছেন।”
টেন্ডার সিন্ডিকেট—ভোলা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার কেন্দ্রে : সূত্র বলছে, বদরুল আলম খান দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী ঠিকাদারি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। ভোলা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার ঠিকাদারদের নিয়ে গড়া এই নেটওয়ার্কে যুক্ত আছে ঢাকার কয়েকজন বিএনপি–জামাতপন্থী ঠিকাদারও—যাদের কাজে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ বহু বিভাগের প্রকৌশলীই করছেন।
সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলো কুমিল্লা ইএম টেন্ডার : অভিযোগ—একজন ভুয়া সার্টিফিকেটধারী ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে বদরুল ঢাকার MIS সেল ও স্থানীয় প্রকৌশলীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। পরে ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
মিরপুর ডিভিশনে ‘আসিফ’ নামের এক ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে চাপ : এই আসিফ নাকি বিভিন্ন থানার ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন এবং তার সাথে বদরুলের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে।
ভাষানটেক থানার ভবন নির্মাণ : পুলিশের ১০৭ থানা প্রকল্পের অধীনে মিরপুরের ভাষানটেক থানার কাজ “পছন্দের ঠিকাদারকে দেয়ার জন্য জোর কাটার” অভিযোগ আছে।
আরবরিকালচার কাজের নিয়মভঙ্গ : আরবরিকালচার বিভাগের কাজ হয়েও বদরুল নাকি মিরপুর ডিভিশনের মাধ্যমে টেন্ডার করান, যা বিধিবহির্ভূত।
দুই দশক ধরে নাকি ডেভেলপার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত : বদরুল আলম খান ও তাঁর ভাইদের মাধ্যমে ২০ বছর ধরে ডেভেলপার ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগও উঠে এসেছে। অভ্যন্তরীণ এক কর্মকর্তা বলেন— “অফিসের বাইরের এসব ব্যবসা তদন্ত করলেই আসল চিত্র বেরিয়ে আসবে।”
বদরুলের পাল্টা দাবি—‘সবই অপপ্রচার’ : বদরুল আলম খান অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি— তাঁকে প্রধান প্রকৌশলীর কাছ থেকে দূরে সরাতেই এই অপপ্রচার। তিনি বাজে কাজ নয়, বরং “ডিপার্টমেন্টের স্বার্থে” সিদ্ধান্ত নেন। কোনো ঠিকাদারি সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন না। কারও ওপর চাপ প্রয়োগ করা হলে সেটাও “ভুল ব্যাখ্যা”।
গণপূর্তে বাড়ছে অস্থিরতা—কর্মকর্তাদের ক্ষোভ তুঙ্গে : প্রকৌশলীদের বড় একটি অংশ বলছে— নিয়োগ–বদলি এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে। প্রকৌশলী থেকে নির্বাহী পর্যন্ত সবাই চাপের মধ্যে কাজ করছেন। বদরুল ও তাঁর নেটওয়ার্কের প্রতি কর্তৃপক্ষ “নরম অবস্থান” নেওয়ায় প্রশাসনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন— “প্রধান প্রকৌশলী ভাল মানুষ, কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। পুরো সিস্টেমটাই এখন কোন অঘোষিত ক্ষমতার কাছে জিম্মি।”
শেষ কথা : গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মীরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন—প্রধান প্রকৌশলী খালেকুজ্জামানের মাধ্যমে ‘গৌরব ফিরে পাওয়ার’—তা আজ নানা অভিযোগ, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি ও প্রশাসনিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত।
অভিযোগগুলো সত্য কি না—তা তদন্তেই প্রমাণ হবে।
কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট—গণপূর্ত অধিদপ্তর আজ এক অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার ঘূর্ণিপাকে, যেখানে বদরুল আলম খানের নামটি কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
