জনতা ব্যাংকের ভয়াবহ লোকসান : ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, কাঠামোগত সংকট ও নীতিগত অস্থিরতার গভীর অনুসন্ধানপূর্বক ব্যাবস্থা গ্রহণ জরুরী ! 

Uncategorized অর্থনীতি কর্পোরেট সংবাদ জাতীয় ঢাকা বানিজ্য বিশেষ প্রতিবেদন রাজধানী সারাদেশ

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক  : বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক দেশের শিল্পায়ন, বৃহৎ প্রকল্প ও রপ্তানি-বাণিজ্য খাতে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ব্যাংকের আর্থিক স্বাস্থ্য ক্রমেই নড়বড়ে হয়ে উঠছে। ২০২৪ অর্থবছরের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৩০৬৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। অভ্যন্তরীণ নথি ও বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সূত্রের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়—এই লোকসান কেবল ব্যবসায়িক ঝুঁকি বা বাজার সংকটের ফল নয়; বরং গভীরতর কাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা এবং নীতি–বাস্তবায়নে গড়িমসিই মূল কারণ।


বিজ্ঞাপন

ব্যাংকের অভ্যন্তরে অস্থিরতা: দক্ষতা কমছে, বিশৃঙ্খলা বাড়ছে ; ব্যাংকের কয়েকজন অভিজ্ঞ কর্মকর্তা, পরিচয় গোপন রাখার শর্তে, জানান যে—শাখা পর্যায়ে অদক্ষ জনবল নিয়োগ ও অস্বচ্ছ বদলি প্রক্রিয়া। দক্ষ কর্মকর্তাদের হঠাৎ করে কম গুরুত্বপূর্ণ বা

অনুপযুক্ত শাখায় বদলি : মাঠপর্যায়ে অভিজ্ঞতার অভাব থাকা সত্ত্বেও কিছু জনবলকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো, মানবসম্পদ সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার ঘাটতি। এর ফলে শাখা পর্যায়ে অপারেশনাল ঝুঁকি বেড়েছে, যা সরাসরি ব্যাংকের আয়ে প্রভাব ফেলছে।


বিজ্ঞাপন

অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও অডিট দুর্বল হয়ে পড়েছে, ঋণ সৃষ্টি, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ও নিয়ন্ত্রক নীতিমালা মানতে শাখাগুলোতে এক ধরনের উদাসীনতা তৈরি হয়েছে বলে কর্মকর্তাদের দাবি।


বিজ্ঞাপন

খেলাপি ঋণ: জনতা ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সংকট : রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই খেলাপি ঋণের মারাত্মক চাপের মুখে। বর্তমানে ব্যাংকটির শ্রেণিকৃত ঋণের হার কয়েক বছর ধরে বাড়ছে।

নীতিগত সহায়তা পেলেও পুনঃতফসিলে গড়িমসি : বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নীতি–সহায়তা পেয়ে যেসব গ্রাহক ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারতেন, অনেক ক্ষেত্রে ফাইল চলতে সময় নিচ্ছে—ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ছে।

জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মতে— “এখন ব্যাংককে বাঁচাতে হলে সবচেয়ে জরুরি ছিল পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ও নতুন সিকিউরড ঋণের মাধ্যমে সিস্টেমে টাকা ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।”

উচ্চ সুদের আমানত সংগ্রহ: বাড়ছে ঝুঁকি : ব্যাংক লোকসান কাটাতে কিছু শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে অস্বাভাবিক উচ্চ সুদের আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এটি স্বল্পমেয়াদে টাকার প্রবাহ বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে— ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যায়, ঋণের সুদের হার, প্রতিযোগিতামূলক থাকে না এবং লোন–ডিপোজিট অনুপাত অস্থির হয়ে পড়ে। ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা এই পদক্ষেপকে “ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক কৌশল” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

মিডিয়া-মুখী প্রচারণা না কি আর্থিক পুনরুদ্ধার ?  ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম উন্নত করার বদলে, শীর্ষ ব্যবস্থাপনার কিছু অংশ ‘ইমেজ বিল্ডিং’-এর দিকে ঝুঁকে পড়েছে—এমন মন্তব্যও পাওয়া গেছে ব্যাংক–পাড়ায়। দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচারণার ফলে ব্যাংকের ব্যয় বাড়ছে, অথচ আর্থিক পুনর্গঠনের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

নিপীড়নমূলক বদলি—যেখানে নীতি দুর্বল, সেখানেই আর্থিক ক্ষতি,
কর্মকর্তাদের মতে—বদলির ভয়, পোস্টিং পেতে লবিং এবং অস্বচ্ছ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।

এসব কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যে কাজের আগ্রহ কমছে, আর এদিকেই সুযোগ নিচ্ছে দুর্বল শাখাগুলোতে থাকা খেলাপি ঋণ খেলোয়াড়রা।

ঋণ সৃষ্টি—যেখানে রীতিমতো স্থবিরতা : একজন সিনিয়র ব্যাংকারের ভাষায়— “নতুন সিকিউরড ঋণ না দিলে, আর পুরোনো খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল না করলে—ব্যাংক কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণে যে ধীরগতি চলছে, তাতেই ব্যাংকের লোকসান আরও বাড়বে।”

পরিস্থিতি বিশ্লেষণে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন—অবস্থার পরিবর্তন না হলে পরবর্তী অর্থবছরে লোকসান ৪০০০ কোটির ঘরে পৌঁছাতে পারে।

রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সংকট—জাতীয় অর্থনীতির জন্য সতর্ক সংকেত : জনতা ব্যাংকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বিপর্যস্ত হলে তার প্রভাব পরোক্ষভাবে—শিল্প খাতে, এসএমই ঋণে, আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে, কর্মসংস্থানে, সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নে তীব্রভাবে পড়ে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির ঐতিহাসিক পর্বগুলোতে জনতা ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেই ব্যাংকই এখন অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ বিশৃঙ্খলা, নীতিগত অস্থিরতা ও নিয়ন্ত্রক ঝুঁকির কারণে গভীর ক্রাইসিসে।

কী করা জরুরি?—বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ : স্বচ্ছ বদলি নীতিমালা ও মানবসম্পদ সংস্কার, ঋণ পুনঃতফসিল প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা, উচ্চ সুদের আমানত সংগ্রহ বন্ধ করে স্থিতিশীল উৎস তৈরি করা, অভ্যন্তরীণ অডিট ও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট জোরদার করা, শীর্ষ ব্যবস্থাপনার ওপর শক্ত নজরদারি, ইমেজ-বিল্ডিংয়ের অতিরিক্ত প্রচারণা নিয়ন্ত্রণ এবং নতুন সিকিউরড ঋণ সৃষ্টি ও আর্থিক প্রবাহ পুনর্গঠন।

উপসংহার  : জনতা ব্যাংকের বর্তমান সংকট কোনো এক ব্যক্তির ভুল নয়; বরং দীর্ঘমেয়াদী প্রশাসনিক দুর্বলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধীরগতি ও কাঠামোগত বিপর্যয়ের সমষ্টি।

এখন প্রয়োজন—স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, পেশাদারিত্ব ও সঠিক নীতিমালা বাস্তবায়ন। অন্যথায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উপর আস্থা তলানিতে পৌঁছাবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে জাতীয় অর্থনীতি।

👁️ 33 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *