নকলবাজ ধরতে মাঠে গোয়েন্দারা

অপরাধ রাজধানী স্বাস্থ্য

মিটফোর্ডের ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

 

বিশেষ প্রতিবেদক : রাজধানীর মিটফোর্ড কেমিক্যাল মার্কেটের ১০ অসাধু ব্যবসায়ী ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবসা করে আঙ্গুল ফুল কলাগাছ বনে গেছেন। এদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দারা খোঁজ খবর নিতে মাঠে নেমেছে।
জানা গেছে, অসৎ ব্যবসায়ীরা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের নামে মিথানল-মিথাইল অ্যালকোহল, উড অ্যালকোহল, উড ন্যাপথা, উড স্পিরিট ইত্যাদি নামে ভেজাল কেমিক্যাল বাজারে বিক্রি করছে। ইথানল বা উড স্প্রিরিটের সাথে পানি ও রং মিশিয়ে ক্ষতিকারক দ্রব্য বাজারে ছাড়ছে। মিথানল খুবই বিষাক্ত এবং হজমের অনুপযোগী। এন্টিফ্রিজ, দ্রাবক ও জ্বালানী ব্যবহার করা হয়।
রাজধানীর মিটফোর্ড কেমিক্যাল মার্কেটে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশের ফুটপাত আর অলিতে-গলিতে দেদারছে যে সব হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করা হচ্ছে। তার সব কিছুর মধ্যেই ইথানল অথবা আইসোপ্রোপল অ্যালকোহলের (আইপিএ) পরিবর্তে মিথানল বা উড স্পিরিট ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এর সাথে মেশানো হচ্ছে পানি ও রঙ। এসব মিথানল মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আর এই মিথানল অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন মিটফোর্ড কেমিক্যাল মার্কেটের অসাধু ব্যবসায়ীরা।
তবে প্রকৃত কেমিক্যাল ব্যবসাীরা জানান, ভেজাল স্যানিটাইজার প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় হঠাৎ গজিয়ে উঠা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে। এ ধরনের ভাসমান দোকান থেকে কোন ধরনের স্যানিটাইজার না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। ফুটপাতে সস্তায় স্যানিটাইজার বিক্রেতারাই কেমিক্যাল মার্কেট থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কম দামে খুঁজতে থাকে।ফলে অসৎ কেমিক্যাল ব্যবসায়ী নিম্নমানের কেমিক্যাল দিয়ে স্যানিটাইজার বানিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করেন।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এসব নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিম্নমানের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও হেক্সিসল বানানোর জন্য উড পলিশ জাতীয় কেমিক্যাল বাজার থেকে সংগ্রহ করছেন। এজন্য আমরা কেমিক্যাল বিক্রির বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হয়েছে। আর যারা উড পলিশ জাতীয় কেমিক্যাল ক্রয় করবেন তাদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তেরির মূল উপাদান আইপিএ অথবা ইথানল। এগুলো শিল্প গ্রেড বা ইলেকট্রন গ্রেড। সাধারণত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোই এসব ব্যবহার করে। আর ভেজাল হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ব্যবহৃত হচ্ছে মিথানল। যা কর্মাশিয়াল গ্রেডর। এসব কেমিক্যাল পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এজন্যই স্বাভাবিকভাবে মিথানল ব্যবহার মানুষের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর।
সূত্র জানায়, মিটফোর্ডের ৮-১০ জন কেমিক্যাল ব্যবাসয়ী ভেজাল বা নকল হ্যান্ড সেনিটাইজার বানানোর কাঁচামাল (মিথানল) ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। তাদের বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা খোঁজ খবর নিচ্ছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড কেমিক্যাল মার্কেটের অসাধু ব্যবসায়ী নকল তাদেরকে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে বার বার সতর্ক করা হয়েছে। কিন্ত তার পরও এখনো কিছু ব্যবসায়ী ভেজাল কেমিক্যাল ব্যবসায়ী সক্রিয় আছে। এই দশজন অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো
অপরএকজন কেমিক্যাল ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমনের যুদ্ধে করো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। ভেজাল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রির সাথে জড়িতরা এই নীতিতে চলছে। তারা অত্যান্ত প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কোন সৎ ব্যবসায়ীই মুখ খুলতে সাহস পায় না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সব কিছুই ‘ম্যানেজ’ করেই ভেজাল ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বানাতে ৭৫ শতাংশ অ্যালকোহল লাগে। এজন্য মূল উপাদান হিসেবে আইসোপ্রোপল অ্যালকোহল (আইপিএ) কিংবা ইথানল ব্যবহার করতে হয়। যেখানে ৭৫ শতাংশ অ্যালকোহল থাকে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে মিথানল দিয়ে বানাচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। আর অ্যালকোহলের পরিমাণ মাত্র ২৫ শতাংশ বা তারও কম ব্যবহার করা হয়। আর সেই সাথে মেশাতে হয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও গ্লিসারিন। তবে জীবাণু ধ্বংস করতে মূল কাজটি করে আইপিএ বা ইথানল যেখানে থাকে ৯৯ শতাংশ অ্যালকোহল। কিন্তু আইপিএ বা ইথানলের দাম বেশি হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছে মিথানল। বাজারে গড়ে এক কেজি আইপিএ’র দাম ৪শ’ টাকা। আর ইথানল কেজি প্রতি গড়ে ৭’শ টাকা। অথচ এক কেজি মিথানলের দাম ৮০ থেকে এক’শ টাকা। মিথানল ব্যবহারে ত্বকের ক্ষতি হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রদুর্ভাব শুরু পর থেকে আইপিএ’র দাম কয়েকগুন বেশী বেড়েছে। এক ড্রাম (১৬০ কেজি) আইপিএ’র মূল্য আগে ছিল ২৫ হাজার টাকা। যা বর্তমানে গ্রেড ভেদে ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিক্রয় করা হচ্ছে। আর সবচেয়ে ভাল মানের আইপিএ কোরিয়ান এলজি কোম্পানি এবং সিঙ্গাপুরের ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে। ফরে চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান থেকেও আইপিএ আমদানি করা হচ্ছে। সরকার হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ট্যাক্স ছাড় দেয়ায় ব্যাপকহারে আমাদানি হবে আগামীতে। ফলে ভাল মানের হ্যান্ড স্যানিটাইজার বর্তমানের চেয়ে কম মূল্যে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
ভেজাল এসব পণ্যের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে র‌্যাব, ঢাকা জেলা প্রশাসক ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশ। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর গত শনিবার শাহবাগ ও তোপখানা রোডে অভিযান চালিায় নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রির অপরাধে ৬টি দোকানকে ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আর গত শুক্রবার হাতিরপুলে ২টি দোকানে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করে। এই দিন বাবুবাজার ও মিটফোর্ডে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৯০০ লিটার নকল স্যাভলন ও ৫০০ লিটার নকল হেক্সিসলসহ গ্রেফতার করে ৭ জনকে।
ভেজাল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের ত্বকের মারাত্বক ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। আর যাদের এলার্জি আছে তাদের হাতের ত্বকে চুলকানির সৃষ্টি করবে বলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানিয়েছেন।


বিজ্ঞাপন
👁️ 1 News Views