
নইন আবু নাঈম তালুকদার (শরণখোলা) : প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝড়-জলোচ্ছাস, জলদস্যুদের আতংঙ্ক আর ভিনদেশী জেলে আগ্রাসনের শংকা মাথায় নিয়ে সুন্দরবনের দুবলার চরাঞ্চলে শুটকি তৈরীর জন্য বঙ্গোপসাগরে যাত্রা শুরু করেছে জেলেরা।

গতকাল শনিবার ভোর রাত থেকে হাজারও জেলে-মহাজন মোংলার পশুর নদীর চিলা মোহনায় জড়ো হয়। তারা একত্রে জাল-নৌকা ও শুটকি তৈরির উপকরন নিয়ে রাত ১২টার দিকে সাগর পাড়ের দূর্গম চরাঞ্চল ও সমুদ্রের উদ্যেশে রওয়ান হবেন। এ শুটকি মৌসুমকে ঘিরে এ বছর সুন্দরবনের দুবলা চরাঞ্চলে অন্তত ৩০ হাজার জেলে-ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের সমাগম ঘটবে বলে বনবিভাগ আশা করছে। সেই সাথে শুটকি প্রক্রিয়াকরন খাতে বনবিভাগের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। বন বিভাগ বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন তারা।
আগামী ৫ মাস (নভেম্বর থেকে মার্চ) পর্যন্ত মোংলা, রামপাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর,বাগেরহাট বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ সুন্দরবন উপকূলের হাজারও জেলে মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরির জন্য সাগরপাড়ে অস্থায়ী বসতি গড়ে তুলবে। এছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবীরাও পৌছাবেন দুবলার চর সহ অন্যান্য চরে।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, মৌসুমের শুরুতেই রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে বন বিভাগ। মোংলা থেকে নদী পথে দুবলা জেলে পল্লীর দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। সুন্দরবন সংলগ্ন এ পল্লীর সব কর্মকান্ড জেলে ও মৎস্যজীবিদের ঘিরে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ৭ টি মৎস্য আহরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতকরণ কেন্দ্র নিয়ে গঠিত দুবলা জেলে পল্লী। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আরো জানান, মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরির জন্য এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরের দুবলা, আলোরকোল, মেহেরআলী এবং শ্যালার চর, অফিস কেল্লা সহ বেশ কয়েকটি চরে তারা পরিদর্শন সহ স্থান নির্ধারন করেছেন।

অপরদিকে জেলেদের অভিযোগ, পুর্বে দুবলার চরে যাওয়ার পথে এবং গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গেলে দস্যুদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতে হতো। মধ্যে ৭টি বছর নিরাপদে মাছ শিকার করতে পারলেও নতুন করে আবারও দস্যু আতংঙ্ক দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভিনদেশী জেলে নামের দস্যুদের উৎপাত তো আছেই। ৭ বছর পর আবারও জেলেদের জিম্মি করে মুক্তিপন বা জেলে বহরে মারধর লুটপাট করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ইলিশ মৌসুম শেষ, আশায় বুকবেধে দেশীয় জেলেরা সমুদ্রে যাত্রা করছে কিন্ত এর আগে থেকেই সাগর থেকে মাছ লুটে নিচ্ছে ভারতীয় জেলেরা। গত ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর এ ২২ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম তাই ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। এখানে দেশীয় জেলেরা সাগরে ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলেও ভারতীয় জেলেরা কিন্ত বসেছিলনা। তারা ভারতীয় সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করে শত শত ফিশিং ট্রলার বাংলাদেশী ইলিশ ধরে নিয়েছে হরহামেসা। তার পরেও দেশীয় জেলেরা শুটকি আহরনের জন্য সমুদ্রে যাত্রা করতে যাচ্ছেন ২৫ অক্টোবর শনিবার রাতে। তাই চলতি মৌসুমে জেলেরা যাতে সাগরে নির্বিঘ্নে মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরি করতে পারে সে জন্য প্রশাসনকে নজরদারি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন সমুদ্রে যাত্রা করা জেলে ও মহাজনেরা।
এ ব্যাপারে মৎস্যজীবিদের সংগঠন ‘দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপ’র সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন জানান, উপকূলীয় অঞ্চলের মৌসুমি জেলেরা জাল-নৌকা ও মাছ আহরণের উপকরণ নিয়ে সমুদ্র যাত্রা শুরু করছেন হাজার হাজার জেলে। তাই জেলেদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানান দুবলা ফিসারম্যান গ্রুপের এ নেতা।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্মকর্তা জানান, সুন্দরবন এবং সাগর এলাকায় সবসময় দস্যু দমন মৎস্য ও বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রানী সংরক্ষনে অভিযান অব্যাহত থাকে। তবে সাগরে শীতকালীন মৎস্য আহরণের জেলেরা যাতে নির্বিঘ্নে তাদের গন্তব্যে পৌছাতে পারে সেজন্য মোংলা থেকে দুবলার চর পর্যন্ত কোস্টগার্ডের টহল দল বিভিন্ন পয়েন্টে প্রস্তুত থাকবে এবং শুঁটকি প্রক্রিয়া করণের জন্য জেলেদের বাড়তি নিরাপত্তা দিতে আরও কঠোর অবস্থানে রয়েছে কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে মৎস্য আহরণ ও সমুদ্র যাত্রাকে ঘিরে উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর মধ্যে আনন্দ আমেজ বিরাজ করছে। এসব পরিবারে স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় বিধির হরেক রকম আনুষ্ঠানিকতাও চলছে জেলে পরিবারের মাঝে।
প্রতি বছর শীত মৌসুমে সুন্দরবনের গহীণে সাগর পাড়ের দুবলা, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আম বাড়িয়া, বড় আম বাড়িয়া, মানিক খালী, কবর খালী, চাপড়া খালীর চর, কোকিলমনি ও হলদাখালীর চরে হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবি জড়ো হয়। এসব চরে অবস্থান নিয়ে জেলেরা সমুদ্র মোহনায় মৎস্য আহরণ করে। পাশাপাশি জেলেরা সেখানে নিজেদের থাকা ও শুঁটকি তৈরির জন্য অস্থায়ী ঘর তৈরি করে। জেলেরা সমুদ্র মোহনায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকারের করে শুঁটকি করার পর তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও বাজারজাত করে থাকেন। #
