
নিজস্ব প্রতিবেদক : নারীর স্বাবলম্বিতা এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়— তা হয়ে উঠছে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এমনই এক প্রেরণার নাম শারমিন সুলতানা, গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার এক সফল নারী উদ্যোক্তা। দীর্ঘ ১৫ বছরের এনজিও অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে তিনি এখন নিজ হাতে গড়া উদ্যোগ “ঘরের স্বাদ” নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশুদ্ধতা ও স্বপ্নের গল্প।

চাকরিজীবন থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা : শারমিন সুলতানা ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন একজন উদ্যোক্তা হবেন। কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিক কারণে যুক্ত হন চাকরিজীবনে। তবুও থেমে যাননি— ১৫ বছর চাকরি করেও মনে লালন করেছেন নিজের উদ্যোগের স্বপ্ন। দুই কন্যাসন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও দায়িত্ব, ভালোবাসা ও দৃঢ়তা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের শিখরে।

‘ঘরের স্বাদ’— স্বপ্ন থেকে সাফল্যে : “ঘরের স্বাদ” শুরু হয় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মাধ্যমে। বড় মেয়ে লাচ্ছা সেমাই খুব পছন্দ করলেও একবার বাজারের সেমাই খেয়ে ফুড পয়জনিংয়ে আক্রান্ত হয়। সেই থেকেই শারমিনের চিন্তা— নিজ হাতে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যসম্মত লাচ্ছা সেমাই বানানো।

ইউটিউব দেখে বহুবার চেষ্টা করেও যখন পারফেক্ট করতে পারছিলেন না, তখন তিনি পেশাদারভাবে লাচ্ছা সেমাই তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। এরপর ঘরোয়া পরিবেশে ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই তৈরি শুরু করেন, যা প্রথমে পরিবারে এবং পরে বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলে।


আজ “ঘরের স্বাদ” শুধু একটি উদ্যোগ নয়— এটি একটি বিশ্বাসের প্রতীক। বর্তমানে প্রতি মাসে তিনি ৩০ থেকে ৪০ কেজি ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই বিক্রি করেন। এছাড়াও গরুর মাংসের আচার, নকশী পিঠা, নাড়ু-লাড্ডু ও মৌসুমি ফলের আচার তাঁর ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় পণ্য।
সব পণ্যই হোমমেড, পিওর ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে প্রস্তুত হওয়ায় ক্রেতাদের আস্থা দ্রুত অর্জন করেছে “ঘরের স্বাদ”।
কাপাসিয়ার নারীদের পাশে এক আলোর দিশারি : নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি শারমিন সুলতানা ভেবেছেন অন্য নারীদের নিয়েও। তিনি কাপাসিয়া উপজেলার পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে গড়ে তোলেন “কাপাসিয়া উপজেলা নারী উদ্যোক্তা গ্রুপ”— যার যাত্রা শুরু হয় মাত্র ৫ জন সদস্য নিয়ে, আর এক বছরে পৌঁছে গেছে ৩০ হাজার সদস্যে!

এই গ্রুপের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্য প্রদর্শন করছেন, বিক্রয় করছেন এবং সরকারি-বেসরকারি প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। নিয়মিত অফলাইন প্রদর্শনী মেলার আয়োজনও করা হয়, যেখানে প্রতি মেলায় গড়ে ৫০ জনেরও বেশি নারী উদ্যোক্তা অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতি উদ্যোক্তার বিক্রি ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা পর্যন্ত হয়।
পরিবার ও সমাজের অনুপ্রেরণায় এগিয়ে চলা : শারমিন বলেন, “আমার সন্তানরা ও স্বামী আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তাদের ভালোবাসা আর সমর্থন না থাকলে হয়তো এতদূর আসা সম্ভব হতো না।”
তিনি বিশ্বাস করেন, নারীর ক্ষমতায়নের মূল চাবিকাঠি হলো আত্মনির্ভরতা। তাই তিনি চান কাপাসিয়ার প্রতিটি নারী উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পরিচয়ে দাঁড়াক।

স্বপ্ন আরও বড় : “ঘরের স্বাদ” ব্র্যান্ডকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চান শারমিন। তাঁর লক্ষ্য— গ্রামীণ নারীদের হাতে কাজ তুলে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা।
তিনি বলেন, “আমি একা নই— আমরা সবাই একসাথে এগিয়ে যেতে চাই। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে একদিন যেন সবাই গর্ব করে বলতে পারে— ‘আমি উদ্যোক্তা, আমি কাপাসিয়া থেকে কাজ করছি।’”
শেষ কথা : শারমিন সুলতানার গল্প শুধু একজন নারীর সাফল্যের নয়, এটি হাজারো নারীর আত্মবিশ্বাস, সাহস ও অনুপ্রেরণার গল্প।
তিনি প্রমাণ করেছেন— স্বপ্ন, পরিশ্রম আর ইতিবাচক মানসিকতা থাকলে ঘর থেকেই গড়ে তোলা যায় সাফল্যের সাম্রাজ্য।
