জ

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার প্রাণকেন্দ্র তেজগাঁও। রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্ট্রেশন এলাকা। অথচ বছরের পর বছর ধরে এই তেজগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স যেন দুর্নীতির এক অদৃশ্য দুর্গ। পত্র-পত্রিকায় একের পর এক অভিযোগ, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, প্রশাসনিক অভিযান—সবই হয়েছে। তবু বাস্তবতা একটাই: রেজিস্ট্রার আসে, রেজিস্ট্রার যায়; কিন্তু দুর্নীতির সিন্ডিকেট থেকে যায়।
ছদ্মবেশে দুদকের অভিযান ও হাতেনাতে ধরা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ : দীর্ঘদিনের অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের , ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক ছদ্মবেশী এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করে তেজগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে।

দুদকের জনসংযোগ দপ্তরের নিশ্চিত তথ্য অনুযায়ী, পৃথক পৃথক অভিযানে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। অভিযান চলাকালে—দুইজন নকলনবিশ এবং একজন দালাল কে অতিরিক্ত অর্থসহ হাতেনাতে আটক করা হয়। পরবর্তীতে তাদেরকে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সোপর্দ করা হয়।

দলিল সার্চ থেকে নকল উত্তোলন—সবখানেই ঘুষের ছাপ : দুদক সূত্র জানায়, ছদ্মবেশে অভিযান পরিচালনার সময় টিম দেখতে পায়— দলিল সার্চ, দলিল যাচাই এবং দলিলের নকল উত্তোলন। এই প্রতিটি ধাপেই সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ সত্য। আরও উদ্বেগজনক হলো—অফিসে কোথাও দৃশ্যমান সিটিজেন চার্টার (নাগরিকদের জন্য ঘোষণাপত্র) পাওয়া যায়নি, দলিল প্রতি নকল ফি ও সার্চিং সেবার নামে আদায়কৃত অর্থের সঙ্গে ট্রেজারি চালানে জমাকৃত টাকার অসংগতি টিমের নজরে আসে যা সরাসরি রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থাপনায় জালিয়াতির আশঙ্কা তৈরি করে।
রেকর্ডরুমে দালালদের অবাধ প্রবেশ ! অভিযানে আরও ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে— রেকর্ডরুমের মতো সংরক্ষিত ও সংবেদনশীল স্থানে এখতিয়ার বহির্ভূত ব্যক্তিদের অবাধ প্রবেশ, দৈনিক হাজিরাভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তদের মাধ্যমে দলিল যাচাই, যা আইন ও বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেবা নিতে আসা গ্রাহকরা দুদক টিমকে জানান—“এখানে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এক ধাপ পেরোতে গেলেই টাকা চাই।”
তেজগাঁও ভূমি অফিসেও একই চিত্র : একই দিনে দুদক তেজগাঁও ভূমি অফিসেও পৃথক এনফোর্সমেন্ট অভিযান চালায়। সেখানে—ভূমি সেবা প্রদানে গ্রাহক হয়রানির অভিযোগ। ছদ্মবেশে সার্বিক সেবাদান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ। এছাড়াও, গত জানুয়ারি মাসে জেলা প্রশাসনের অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত ৬ জন দালালের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়ের করা মামলার তথ্য সংগ্রহ করে দুদক টিম।
প্রতিবেদন কমিশনে—কিন্তু ফল কোথায় ? দুদক জানিয়েছে, দুই অভিযানের বিস্তারিত প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করা হবে। কিন্তু এখানেই উঠছে বড় প্রশ্ন —সরকার পতনের পরও কেন থামছে না দুর্নীতি? গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটে। প্রশাসনে শুদ্ধতার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এক বছর পেরিয়ে গেলেও তেজগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। বরং অভিযোগ উঠেছে—আগের চেয়ে আরও বেপরোয়া ও সংগঠিত হয়েছে দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট।
শেষ কথা : সিন্ডিকেট ভাঙবে কে ? দুদকের অভিযান দুর্নীতির চিত্র উন্মোচন করেছে, কিন্তু অভিযানের পর দালাল সিন্ডিকেট ভাঙা হয়েছে কি ? সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় বা ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি? ট্রেজারি অর্থের অসংগতি তদন্তে কোনো মামলা হয়েছে কি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না আসা পর্যন্ত তেজগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতি কেবল একটি অফিস নয়— পুরো রাষ্ট্রীয় সেবা ব্যবস্থার জন্য একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত হয়েই থাকবে।
