রাজশাহী গণপূর্তে ‘নিজেদের জন্য রাষ্ট্রীয় টাকার ভাগ’: আত্মীয়–বন্ধুদের হাতে আগাম কাজ, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম

Uncategorized অনিয়ম-দুর্নীতি অপরাধ আইন ও আদালত জাতীয় বিশেষ প্রতিবেদন রাজশাহী সারাদেশ

নিজস্ব প্রতিনিধি (রাজশাহী)  :  রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ–১ যেন এখন আর একটি সরকারি দপ্তর নয়—বরং পরিণত হয়েছে আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের জন্য নিশ্চিত ঠিকাদারি স্বর্গে। দরপত্রের নামে চলছে লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা, আর বাস্তবে কাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে আগেই—এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে বিভাগটির নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি এবং ‘আগে কাজ—পরে টেন্ডার’ সংস্কৃতির মাধ্যমে কোটি টাকার সরকারি বরাদ্দ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগে এখন তীব্র ক্ষোভে ফুঁসছেন বঞ্চিত ঠিকাদাররা।


বিজ্ঞাপন

১০ কোটি টাকার বরাদ্দ—কয়েকজনের পকেটে ?  গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ–১ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জরুরি সংস্কারকাজের জন্য প্রায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই বিপুল অর্থের বড় একটি অংশ প্রকৃত দরপত্র প্রতিযোগিতা ছাড়াই নির্বাহী প্রকৌশলীর আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ ঠিকাদারদের অভিযোগ, তারা নিয়মমাফিক ইজিপি (e-GP) তে অংশ নিলেও কাজ পাচ্ছেন না। কারণ—কাজের ভাগ্য নাকি নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে টেন্ডার প্রকাশের আগেই।

দীর্ঘদিন রাজশাহীতে অবস্থান, সখ্যতাই কাল ?  নোয়াখালীর বাসিন্দা রাশেদুল ইসলাম বাবার চাকরিসূত্রে ছোটবেলায় রাজশাহীতে আসেন। এখানেই তাঁর পড়াশোনা। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) থেকে স্নাতক শেষ করে গণপূর্ত বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন তিনি।


বিজ্ঞাপন

চাকরিজীবনের প্রায় ১৬ বছর রাজশাহীতেই কাটিয়েছেন।
অল্প সময়ের বদলি শেষে সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে আবার রাজশাহীতে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।


বিজ্ঞাপন

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিনের স্থানীয় যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত সখ্যতাই এখন দুর্নীতির প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা—এভাবে লাগামহীন থাকলে রাজশাহী গণপূর্ত আরও গভীর সংকটে পড়বে।

স্ত্রীর চাচাতো ভাইয়ের হাতে আদালত ভবনের কাজ !অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ভবনের প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার সংস্কারকাজ পেয়েছেন মো. রফিক নামের এক ঠিকাদার—যিনি নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের স্ত্রীর আপন চাচাতো ভাই। এতেই শেষ নয়। একই ঠিকাদার গণপূর্ত বিভাগের জোন কার্যালয়ের ছাদ সংস্কার ও টাইলস বসানোর আরও দুটি কাজ করছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে, রাশেদুল ইসলামের আরেক নিকটাত্মীয় ফয়সাল কবির রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের একটি সংস্কারকাজ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বন্ধুর জন্য আগাম ‘ফাইনাল’ কাজ !  সবচেয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ—টেন্ডার হওয়ার আগেই রাজশাহীর সার্কিট হাউস ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংস্কারকাজ নির্বাহী প্রকৌশলীর বন্ধু ইয়াসির আরাফাতকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। বঞ্চিত ঠিকাদারদের দাবি, এসব কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের অনেকেরই সংশ্লিষ্ট কাজে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা নেই। তবুও তাঁরা ‘বিশেষ পরিচয়ে’ একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন।

ঠিকাদারদের ক্ষোভ : “অযোগ্যরা রাজা, যোগ্যরা বঞ্চিত”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন,
“নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যোগ্য ঠিকাদাররা কাজ পাচ্ছেন না। অযোগ্য ও অনভিজ্ঞদের হাতে কোটি টাকার কাজ তুলে দেওয়া হচ্ছে। এটা আর গোপন কিছু নয়।”

অভিযোগ শুনে ক্ষুব্ধ প্রকৌশলী, চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন গণমাধ্যমকে  :  রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একাধিক ঠিকাদারের উপস্থিতি। অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, “তাঁরা আগে থেকেই ঠিকাদার। ইজিপি প্রক্রিয়ায় যে যোগ্য, সেই কাজ পায়।” গোপন দরপত্র ফাঁসের অভিযোগও তিনি নাকচ করেন। তবে অনিয়ম প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের প্রশ্নে তাঁর আরেক বক্তব্য আরও বিতর্ক উসকে দিয়েছে।

তিনি বলেন, “আপনারা আর কোনো নিউজ পান না? শুধু আমাকে পেয়েছেন? আপনি নিউজ করেন, আমার কিছু হবে না।” এই বক্তব্যই যেন অভিযোগকারীদের সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে।

‘আগে কাজ, পরে টেন্ডার’ –স্বীকারোক্তি ?  অন্যদিকে, তাঁর সম্বন্ধী ঠিকাদার মো. রফিক বলেন, “জরুরি মেরামতকাজে অনেক সময় কাজ শুরু হয় আগে, পরে টেন্ডার হয়। এখানে নতুন কিছু নয়।”এই বক্তব্যকে অনেকেই দরপত্র আইন ও স্বচ্ছতার সরাসরি পরিপন্থী স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখছেন।

উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কী বলছে ?  রাজশাহী গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল গোফফার বলেন, “টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যে কেউ অংশ নিতে পারেন, আত্মীয় হলেও বাধা নেই। তবে গোপন দরপত্র ফাঁস বা অনিয়ম হয়ে থাকলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”

তদন্তের দাবি জোরালো :  স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে এবং কোটি টাকার সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বঞ্চিত ঠিকাদারেরা। তাঁদের প্রশ্ন— রাজশাহী গণপূর্ত কি তবে একটি পরিবারের ঠিকাদারি আড্ডাখানায় পরিণত হচ্ছে ?  ইজিপি’ কি এখানে শুধু লোক দেখানো নিয়ম ? এই প্রশ্নের উত্তর এখন প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন সংস্থার কাছেই প্রত্যাশিত।

👁️ 80 News Views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *