জাল টাকার কারবারীরা

অপরাধ

ঈদকে সামনে রেখে শতাধিক গ্রুপের মাঠে নামার প্রস্তুতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : সক্রিয় জাল টাকা তৈরির কারিগর। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় বিপণনকারীসহ প্রায় শতাধিক গ্রুপ মাঠে। প্রতিবারের মতো এবারও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এসব চক্রের সদস্যরা তাদের কর্মকান্ড শুরু করেছে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে টার্গেটকৃত জাল নোট বাজারে ছাড়ার চেষ্টা করছে। এসব জাল নোট তৈরী ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা মাঝে মধ্যেই র‌্যাব, পুলিশ, ডিবিসহ গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গ্রেফতার হচ্ছে। আবার খুব সহজেই কারাগার থেমে জামিনে ছাড়াও পাচ্ছেন। এরপর পুনরায় একই পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাল টাকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরিং শক্তিশালী করা প্রয়োজন। জড়িতদের আর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আইনের সংশোধন করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, জাল টাকার তৈরী ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা পরিচালনার জন্য পৃথক আদালতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
গত জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাজধানীর অভিজাত এলাকার এক বাড়িতে জাল টাকা তৈরির কারখানার সন্ধ্যান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর রাজধানীর যাত্রাবাড়ি,ফকিরাপুল ও সবুজ এলাকায় গত বছর ঈদের আগে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে জাল টাকার একাধিক চক্র গ্রেফতার হয়। ওই সব চক্রের সদস্যরা আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় জাল টাকা তৈরী ও ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, গত ১০ জানুয়ারি নগরীর অভিযাত এলাকার ধানমন্ডি-৭/ই এর ১০ নম্বর বাড়ির তিন তলার এক ফ্ল্যাটে জাল টাকা তৈরীর কারখানার সন্ধান পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এসময় ওই বাসার একটি কক্ষে থাকা ওয়ারড্রপ ও খাটের নিচ থেকে কয়েক কোটি জাল টাকা, টাকা তৈরির কাগজ, প্রিন্টার, টোনার, কেমিকেল, ডায়াসসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আর উদ্ধারকৃত জাল টাকাগুলো ৫০০ এবং ১০০০ হাজার টাকার নোট ছিল। এই জাল টাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকায় দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, সাইফুল ইসলাম ও শাহ আলম।
ঘটনার দিন শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানের পর র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি কাইয়ুমুজ্জামান বলেছিলেন, ঘটনার দিন ১০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার যাত্রাবাড়ী এলাকা ১ লাখ ৯০ হাজার জাল টাকাসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পশ্চিম ধানমন্ডির সাইফুলের বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে ওই বাসার ওয়ারড্রপ ও খাটের নিচ থেকে জাল টাকা ও টাকা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করে র‌্যাব।
সূত্র জানায়, জাল টাকা তৈরী ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকা নিরাপদ মনে করে অরাধীরা। তারা মনে করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান এলাকায় অবৈধ কর্মকান্ড হতে পারে না বলে তাদের সন্দেহের বাইরে থাকে। এজন্য ধানমন্ডি গুলশানের মত এলাকায় বহুতল ভবনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরীসহ অবৈধ সব ধরনের কার্যক্রম চালানো হয়। তার পরও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব প্রতারকচক্র আইনে চোখ ফাঁকি দিয়ে পার পাচ্ছে না।
সূত্রটি আরো জানায়, জাল টাকার কারিগর সাইফুল ইসলাম গত ২০১৪ সালে ধানমন্ডিতে দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরীর কাজ শুরু করে। সেখানে তিনি তার স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন। আর সূর্য গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেন তিনি তৈরি করতেন কোটি কোটি টাকার জাল নোট। এরপর তার নিজস্ব ও বিশ্বস্ত বিপণনকারীদের হাতে এসব টাকা তুলে দিতেন। প্রতিনিয়ত জাল টাকার কারবারিরা তার বাসায় আসতেন। এই প্রতারক অভিজাত এলাকা ধানমন্ডিতে দীর্ঘদিন থাকায় মহল্লার বাসিন্দাদের মাঝে ব্যাপক সুনামও কামিয়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, তার বাসার নিচের দোকানিদের সঙ্গে সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন, ভালো ব্যবহার করতেন। কখনো কোন দোকান থেকে বাকি খেতেন না। কিন্তু কখনোই কেউ ভাবেনি এই প্রতারক মানুষটি নগরীর অন্যতম জাল টাকা তৈরির কারিগর। অভিযানের আগ মুহুর্ত কেউ বুঝতেই পারেননি যে, তিনি নকল টাকার টাকশালের মালিক। আর পাশের ফ্ল্যাটে এমন কান্ড, কিন্তু এতো দিন ধরে টেরই পায়নি বাড়ির মালিকসহ প্রতিবেশীরা। তবে জাল টাকা তৈরী ও ব্যবসার বিষয়ে তার স্ত্রী জানতেন বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এছাড়া গত বছর আগস্ট মাসে জাল টাকা ও ভারতীয় জাল রুপি তৈরি চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৯০লাখ টাকার জাল নোট ও ২৬ লাখ জাল রুপি উদ্ধার করা হয়।
প্রতিবছর ঈদ সামনে রেখে জাল টাকা তৈরির চক্র সক্রিয় হওয়ার চেস্টা করে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাগণ জানিয়েছেন। তবে এসব প্রতারকচক্রের অপতৎপরতা রোধে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বছর ১ আগস্ট ফকিরাপুল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫০ লাখ জাল টাকাসহ চক্রের অন্যতম সদস্য লাল মিয়া ও শহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিন পৃথক অপর এক অভিযানে সবুজবাগ এলাকায় থেকে আবিদা সুলতানা ও আলামিন নামে অপর দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ৪০ লাখ ২০ হাজার জাল টাকা উদ্ধার করা হয়। গত বছরের ঈদুল আজ্হাকে সামনে রেখে জাল টাকা তৈরীর চক্রটি গরুর হাটসহ বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধারকৃত জাল টাকা সরবরাহ করত। গ্রেফতারকৃত আবিদার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আগেই তিনটি মামলা ছিল। জাল টাকার কারিগর লিয়াকত হোসেন ওরফে জাকির, শান্তা আক্তার ও মমতাজ বেগম। এই চক্রটি পোষাক ও গরু ব্যবসায়ীদের মাধ্যে জাল টাকার ব্যবসা করে। চক্রটির মূল হোতা লিয়াকত হোসেন জাল রুপি দেশের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের আগ্রী ব্যবসায়ীদের চাহিদা মোতাবেক জাল টাকা সরবরাহ করত। আর শান্তা ও মমতাজ জাল রুপি তৈরির দক্ষ কারিগর। এসব জাল টাকার কারিগর কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে পুনরায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া নিয়ে জাল টাকার তৈরী ও ব্যবসা শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, করোনার কারণে পুলিশের অন্যান্য অভিযান অনেকটা কমলে এসব অপরাধীদের বিষয়ে নজরদারী অব্যাহত রয়েছে।


বিজ্ঞাপন
👁️ 14 News Views